সজিনা/ সাজনা পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা-সজনে পাতার পুষ্টিগুন
সজিনা বা সাজনা বা সজনে গাছের পাতা আমরা কমবেশি প্রায় সবাই চেনে থাকি এবং এক এক এলাকায় এক এক নামে ডাকি। তবে যে নামেই ডাকিনা কেন, জিনিস ও পুষ্টিগুন কিন্ত একই। সজিনা গাছ সম্পূর্ণ পুষ্টিগুণে ভরা । এই গাছের পাতা, বাকল, কান্ড সবকিছুই পুষ্টিতে ভরা খাওয়া যায়।
বর্তমানে সজিনা পাতা কে বলা হয় সুপার ফুড বা পুষ্টির ডিনামাইট। তাই গবেষকরা সাজনা পাাতাকে মিরাক্কেল টি বা সুপার ফুড বলে আখ্যা দিয়েছেন। সজিনা পাতা শরীরের প্রায় ৩০০ রোগের প্রতিশোধক হিসেবে কাজ করে। আগে সজনে গাছ এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশে পাওয়া যেত, তবে পরবর্তীকালে সজনে গাছের পাতা এবং গাছের ডাটা উপকারিতা জানার পর সারা বিশ্বে সজনে গাছের বিপুল পরিমাণ চাষ হয়।
আরো পড়ুনঃ ভাজাপোড়া তেল পুনরায় ব্যবহার করার নিয়ম-রান্নার নিয়ম কানুন
এছাড়াও প্রাচীন ভারতবর্ষে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায়ও সজনে গাছের বিশেষ ভূমিকা ছিল। সজনে পাতা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং দেহকে সুস্থ রাখে। এখনকার দিনে আমরা অনেকেই সুপার ফুড সম্পর্কে জানি। মরিঙ্গা পাউডার বা সজনে পাতার গুঁড়া তার মধ্যে অন্যতম একটি।
পোস্ট সূচিপত্র
সজনে পাতার পুষ্টিগুণ
এই পাতা কেউ শাক অথবা ভর্তা হিসেবেও খায় । কিন্ত আমরা অনেকে সজনে পাতার পুষ্টিগুন সম্পর্কে জানিনা। চলুন আজকে আপনাদের সাথে সজনে পাতার পুষ্টিগুন, উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত আলোচনা করব। প্রতি ১০০ গ্রাম সাজিনা পাতায় নিম্মে উল্লেখিত পরিমাণ পুষ্টিগুন থাকে।
- ক্যালোরি ৬৪ শতাংশ
- প্রোটিন ৯.৪ শতাংশ
- কার্বোহাইড্রেট ৩৮ শতাংশ
- ফ্যাট ১.৪ শতাংশ
- আমিষ ২৭ শতাংশ
- ফাইবার বা আশ ১৯ শতাংশ
- ফ্যাট আছে ২ শতাংশ
এছাড়াও এতে আছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এবং মিনারেল। ভিটামিন এ, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ ও সেলেনিয়াম ইত্যাদি।
সজনে পাতার উপকারিতা
সাজনা পাতায় রয়েছে নানা রকম ঔষধিগুণ । বলা হয়ে থাকে যে, লেবু থেকে প্রায় সাত গুণেরও বেশি ভিটামিন সি রয়েছে এই পাতায় এবং ডিমের থেকেও প্রায় দুই গুনেরও বেশি প্রোটিন রয়েছে সজনে পাতায়। এতে রয়েছে দুধের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম। অন্ধত্ব দূর করতেও এটি কাজ করে। গাজরের চেয়েও ৪ গুন বেশি ভিটামিন-এ রয়েছে সজিনা পাতায়। অত্যন্ত স্বাস্থ্য গুনাগুন সম্পন্ন এই পাতায় কয়েকটি বিশেষ উপকারিতা পাওয়া যায় যা হল,,--
কোলেস্টেরল ও সুগার নিয়ন্ত্রণ
মানুষের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই সজনে পাতা অন্যতম ভূমিকা পালন করে। শুধু কোলেস্টেরলে নয়, এটি শরীরের সুগারের মাত্রা ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই ডায়াবেটিসের মতো কঠিন রোগের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে এটি।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
সজনে পাতা নিয়মিত খেলে আমাদের শরীরের ডিফেন্স ম্যাকানিজম আরো বেশি শক্তিশালী হয়। এটি ইমিউনিটি স্টিমুলেন্ট হওয়ার কারণে এইডস রোগে আক্রান্ত রোগীর জন্যও উপকারী। শারীরিক ব্যায়ামের পাশাপাশি সজনে পাতাও মানুষের শরীরে ওজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে
সজনা পাতা উচ্চ রক্তচাপ কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিনে চার থেকে ছয় চামচ সজনে পাতা গুড়া উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। এর ফলে নিয়ন্ত্রণে আসে রক্তচাপ এবং হঠাৎ রক্তচাপের অস্বাভাবিক ওঠানামা কম হয়। তাই একথা বলা যায় যে, নিয়মিত যদি সজনে পাতার গুড়া খাওয়া হয় তাহলে উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ বর্জন করা সম্ভব হবে।
হজম শক্তি বৃদ্ধি করে
শরীরে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে সজনে পাতা। এটি একটি পুষ্টিবর্ধক হিসেবেও কাজ করে থাকে। আমাদের মধ্যে অনেকের পেটের সমস্যা বা খাবার হজম না হওয়া এসিডিটি এবং পেটে গ্যাস হওয়া ইত্যাদির জন্য নানারকম সমস্যা দেখা যায়। সজনা পাতাতে রয়েছে ফাইবার এবং ভিটামিন বি যা আমাদের হজম শক্তিকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
দেহের প্রায় ২০% প্রোটিনের গঠন একক হচ্ছে অ্যামাইনো এসিড। এই অ্যামাইনো এসিড আমাদের শরীরে নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণভাবে সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্যের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয় সেগুলোর প্রায় সবগুলোই এই পাতার মধ্যে রয়েছে। তাই এই পাতা নিয়মিত খেলে হজম জনিত সমস্যা দূর হতে হবে।
আরো পড়ুনঃ আলু বা পেয়াজ সংরক্ষনের পদ্ধতি ও উপায়।
খাবারের রুচি বৃদ্ধি
দীর্ঘদিন নানা রোগে আক্রান্ত থাকলে আমাদের খাবারের প্রতি একটি অনীহা বা অনিচ্ছা জন্ম নেয়। যার কারণে খাবার খেতে ভালো লাগে না কিন্তু এসব সমস্যায় সাজনা পাতা অনেক কার্যকরী একটি সমাধান। খাবারের অরুচি দূর করে স্বাভাবিক রুচি ফিরিয়ে আনতে এই পাতা বেশ ভালোভাবে কাজ করে। তাই বলা যায় খাবার রুচি বৃদ্ধিতে মরিঙ্গা পাউডার বা সজনে পাতা খুবই উপকারী একটি পাতা।
আয়রনের উৎস
সজনে পাতাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। যাদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি থাকে তারা সজনে পাতা নিয়মিত খেলে শরীরের আয়রন জনিত সমস্যা দূর হবে। শরীরে এনিমিয়া অর্থাৎ রক্তস্বল্পতা সমস্যা দূর করতে এই পাতা নিয়মিত সেবন করা উচিত।
হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতে
সজনে পাতা ব্লাড সুগার ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে। ব্লাড সুগার ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রে রক্তের চাপ ও প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখতে বেশ ভূমিকা পালন করে সজনে পাতা । তাই বলা যায় হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখতে হলে নিয়মিত এই পাতা খাওয়া উচিত।
কিডনি ও যকৃত সুস্থ রাখে
কিডনি ও যকৃতকে সুস্থ রাখতে সজনে পাতার গুনাগুন অনস্বীকার্য। এরমধ্যে রয়েছে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য যা কিডনি এবং যকৃতকে সুস্থ রাখে। এছাড়াও এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের যকৃত বা লিভারের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে পুনরায় সচল কোষে রূপান্তরিত করে।
ব্যথা নিরাময়ে
সজনে পাতা ব্যথা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। এতে রয়েছে এন্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান যা আমাদের দীর্ঘদিনের ব্যথাকে অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে। বহু সময় ধরে যদি আমাদের কোন ধরনের ব্যথা বা যন্ত্রণা হয়ে থাকে,- যেমন হাঁটুতে, হাতে ও কোমরে ইত্যাদি, তাহলে যদি আমরা নিয়মিত সজনে পাতা বা মরিঙ্গা পাউডার সেবন করি তাহলে সেই ব্যথার অনেকটাই উপশম হয়।
আর্সেনিকের ভয়াবহতা কমাতে
আর্সেনিক আমাদের শরীরের জন্য ভীষণ ক্ষতিকারক। যদি আমাদের শরীরে আর্সেনিকের ভয়াবহতা বাড়তে থাকে, তাহলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আস্তে আস্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এতে আমাদের শরীরে দেখা দিতে পারে ভয়াবহ ক্যান্সার। সাধারণত দুটি উপায়ে আমাদের শরীরে আর্সেনিক প্রবেশ করে। এক দূষিত পানি পান করার মাধ্যমে আর দূষিত ভাত অথবা খাওয়ার গ্রহণ করার মাধ্যমে। সজনে পাতাতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান যা বিষাক্ত আর্সেনিকের প্রভাব কমিয়ে আনে।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বজায় রাখতে
সজনে পাতা ত্বক এবং চুলের জন্য খুবই উপকারী কাজ করে। কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। যা আমাদের ত্বককে উজ্জ্বল করে তোলে। আমাদের ত্বকের মৃত কোষ গুলোকে সরিয়ে, নতুন কোষ উৎপন্ন হতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি চুল পড়ে যাওয়ার প্রবণতাকে কমিয়ে আনে চুলের গোড়া মজবুত করে।
এছাড়াও সজনে পাতা তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ খনিজ পদার্থ ও মিনারেল, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস যা আমাদের শরীরের হাড়কে শক্ত ও দৃঢ় করতে সাহায্য করে।
আরো পড়ুনঃ বুদ্ধি বাড়ানোর ১৫টি উপায় ও কৌশল।
সজনে পাতার অপকারিতা
আমাদের জানা উচিত যে সজনে পাতা কতটা উপকারী ও অপকারী। খুব একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় নি তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে না খাওয়াই ভালো।
- সজনে পাতার গুড়াতে বা পাতাতে প্রচুর পরিমাণ মিনারেলস ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। তাই খুব বেশি পরিমাণ সজনে পাতা গ্রহণ করা উচিত নয়। এতে ক্ষুধা মন্দা এবং হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি ক্ষুধা মন্দা থেকে খাবারের অরুচি পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডায়রিয়া হতেও পারে।
- সজনে পাতাতে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপাদান। যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তারা নিয়মিত এই পাতা খেলে রক্তচাপ একেবারে কমে যেতে পারে। তাই সাবধানতার সাথে উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ গ্রহণ করতে হবে। অথবা দীর্ঘদিন পাতা এবং ঔষধ দুটো একসাথে না খাওয়া।
- সজনে পাতা শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদের না খাওয়াই ভালো। কারণ এতে রয়েছে কেমিক্যাল প্লান্ট যা পরবর্তী ও শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।
- নিয়মিত সজনে পাতা খেলে বা শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম বেড়ে যায়। কিন্তু সজনে পাতা বা ডাটা খাওয়া যেতে পারলেও সজনে পাতার ডাল বা মূল খাওয়া উচিত নয় এতে ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে যা শরীরের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
সাজনা পাতার গুড়া খাওয়ার নিয়ম
খালি পেটে এক গ্লাস নরমাল পানিতে ২ চা চামচ সজনে পাতা মিশিয়ে খেতে পারেন। সাজনা পাতার সঠিক পুষ্টি গুনে পেতে চাইলে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে এক গ্লাস নরমাল পানির সাথে ২ চা চামচ সজিনা পাতার গুড়া মিশিয়ে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখবেন। পরে পাতার রাসটা খেয়ে নিবেন। এতে ভালো ফলাফল পাবেন। এছাড়া আরো কিছু নিয়মে খেতে পারেন যেমন--
- পেয়ারার সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
- তরকারির সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
- ডালের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
- ডালের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
- দুধের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
- শাকসবজির সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
- আমড়ার সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
- কাচা আমের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
- মধুর সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।
সাজিনা পাতার কিছু ঔষুধি গুন আছে এবং এ ঔষুধি গুনের কারনে আথ্রাইটিস নিরাময়ে এটি দারুন কার্যকর। যাদের হাঁটু ব্যাথা আছে, সজনে পাতার জুস খাবেন। সজনে পাতার ভর্তা খাবেন অথবা গুড়া করে খাবেন। এভাবে ছয় মাস খাবেন দেখবেন আপনার আর্থাইটিসের অবস্থা অনেক পজেটিভ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url