নরসিংদীর লটকন বাগান বাইক টুর ২০২৩- যেভাবে যাবেন নরসিংদী

দেশীয় ফলের মধ্যে লটকন অন্যতম একটি ফল। বাজারে অন্যান্য ফলের তুলনায় লটকনের দাম মোটামুটি সাধ্যের মধ্যে। ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সবাই ক্রয় করার ক্ষমতা রাখে। লটকন একটি মজাদার ফল। যা মোটামুটি সবাই পছন্দ করে।

নরসিংদীর লটকন বাগান বাইক টুর ২০২৩- যেভাবে যাবেন নরসিংদী

বাজারে প্রাপ্ত লটকন বেশির ভাগ আসে নরসিংদী থেকে। নরসিংদী জেলা লটকনের জন্য বিখ্যাত। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অনেক গুলো লটকনের বাগান রয়েছে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে এসব বাগানের লটকন রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।

পোস্ট সূচিপত্র

নরসিংদীতে লটকন চাষের ইতিহাসঃ 

নরসিংদীর লটকন চাষের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় একশত বিশ বছর পূর্বে নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের আজকিতলা গ্রামে লটকন চাষ শুরু হয়।
জেলায় লটকনের সূত্রপাত ঘটে তখন কার কৃষক লটকন চাষী মরহুম হাজী আব্দুল আজিজের হাত ধরে। সময়ের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে নরসিংদী জেলার রায়পুরা এবং বেলাবো উপজেলার লালমাটির এলাকায় লটকনের আবাদ শুরু হয়।

ক্লাব টিআইবির বাইক ট্যুর,২০২৩

The Invincible 9/11 Bikers দেশের অন্যতম একটি বাইকার গ্রুপ। যা ক্লাব টিআইবি নামে বেশ পরিচিত। এস এস সি ২০০৯ এবং এইচএসসি ২০১১ সালের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে এই গ্রুপটি পরিচালিত হচ্ছে। এই গ্রুপের উদ্যোগে বছরের বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বাইক টুর দেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২১-৭-২০২৩ সালে আমাদের বাইক টুরের প্ল্যান ছিল নরসিংদীর লটকন বাগান ভ্রমণ। 

 
ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ১০০
+ বাইকার বন্ধুরা এই বাইক ট্যুরে জয়েন করে। আমাদের রোড প্লান ছিল ঢাকা থেকে আগত বন্ধুরা পূর্বাচল ৩০০ ফিট হয়ে কাঞ্চন ব্রিজ দিয়ে ভুলতা, গাউছিয়া, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ আসি অপরদিকে কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রাম জেলার ঐদিকের বন্ধুরা ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে অবস্থিত কাচপুর হয়ে ভুলতা, গাউছিয়া রুপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ আসি।
আমাদের গাউছিয়া একসাথ হওয়ার কথা ছিল সকাল ৮.০০ ঘটিকায়। কিন্তু রাস্তায় জ্যাম এবং কুমিল্লা চট্টগ্রাম বন্ধুদের দূর হওয়ার কারণে তারা আসতে দেরি হয় ফলে আমরা ঢাকার বন্ধুরা নরসিংদী দিকে রওনা দেই। 
আমাদের সবার টি-শার্ট ছিল একইরকম এবং বাইক চালানোর নিয়ম ছিল আমাদের রূলস অনুযায়ী। ফলে আমাদের দেখে রাস্তার দুই পাশের মানুষের মধ্যে কৌতূহল এবং সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। রাস্তার দুইপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য, মনোরম প্রকৃতি সেই সাথে এমন বাইক রাইড সত্যি অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। যেটা কেবল একজন ভ্রমণ  প্রিয়াষু মানুষ বুঝতে পারবে। 


বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকাল ৯.৩০ এরমধ্যে সাহিপ্রতাপ বাজার নরসিংদী সদরে পৌঁছি । তারপর সেখানে কুমিল্লার বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি এবং যে যার মত নাস্তা করি। প্রায় আধা ঘন্টা পর কুমিল্লা বন্ধুরা সেখানে পৌছে যায় এবং সকাল ১০.০০ টায় আমরা সাহেপ্রতাপ থেকে লটকন বাগানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। প্রায় ১০.৪৫ মিনিটে আমরা মরজাল বাজার বাস স্ট্যান্ড এ পৌঁছে যাই। যেটা নরসিংদীর লটকন বাজার হিসেবে বেশ পরিচিত।

মরজাল বাসস্ট্যান্ডের বাম পাশ দিয়ে আমরা লটকন বাগানে উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশে অনেকগুলো বাগান আমরা পরিদর্শন করলাম এবং বিভিন্ন ফটোশুট করলাম। লটকন বাগান গুলো দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আল্লাহ সৃষ্টি কতই না সুন্দর। রাস্তা দুপাশে সারিসারি লটকন গাছ। লটকন ধরে আছে। সেই এক  অপরূপ দৃশ্য। প্রকৃতির অপার মায়ায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। এলাকার মানুষগুলো বেশ মিশুক। বিশেষ করে বাগানের পাশের ঘর-বাড়ির মানুষ।
 

তারা আমাদের পানি দিয়ে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। যেহেতু প্রচন্ড রোদ আর গরম ছিল , আমরা অনেক তৃষ্ণার্ত ছিলাম। কিন্তু আমাদের সাথে যে পানি ছিল সেটা দিয়ে পানির তৃষ্ণা মিটানো সম্ভব ছিল না। পানি দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।  লটকন বাগানের সাথে আছে কাঁঠাল বাগান।  বাগানের মধ্যে কাঁঠাল গাছ+লটকন একই সাথে। কাঁঠালগুলো বেশ চমৎকার ও অনেক বড়। 

দেখলে যেমন চোখ জুড়িয়ে যায় ঠিক খেতেও অনেক সুমিষ্ট। এখানে মালিককদের সাথে কথা বলে অনেক তথ্য জানতে পারি, নরসিংদীর মাটি লটকন চাষের জন্য বেশ উপযুক্ত। লটকন ফল ছায়াযুক্ত স্থানে বেশ ভালো জন্মে। আপনি গেলে দেখতে পাবেন বাগান গুলো অনেকটা ছায়াস্থানে অবস্থিত। আশেপাশের পরিবেশটা অনেক নীরব ও শান্ত।

মালিকরা আরো বলেন, এই মৌসুমে নরসিংদীতে ১৬৯৫ হেক্টর জমিতে লটকনের চাষাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছে জানতে চাই, আপনাদের ধারণা অনুযায়ী কেমন টাকা বিক্রি হবে বলে আশা করেন, তিনি বলেন, আগের তুলনায় খরচ বেড়ে গেছে, পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি বেড়ে গেছে। ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। তারপরেও পাইকারি আমরা ১০০ টাকা  থেকে ১২০ টাকা করে বিক্রি করতে পারলে আমাদের আড়াইশো কোটি টাকার মতো বিক্রি হওয়া সম্ভাবনা রয়েছে।

নরসিংদী জেলার সদর, বেলাবো, শিবপুর, মনোহরদী, পলাশ ও রায়পুরায় আংশিক অঞ্চলে লটকন চাষাবাদ করা হয়। বাগানের সংখ্যার দিক থেকে বেলাবো উপজেলায় সবচেয়ে বেশি লটকন বাগান রয়েছে। চাষিরা জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবেই লটকন চাষবাদ শুরু হয়েছে। এর পূর্বে সবাই শখের বসে পারিবারিক ভাবে বাড়ির আঙিনায় লটকন গাছ লাগাতো কিন্তু যখন অধিক ফলন হওয়া শুরু করে এবং নিজেদের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে তা বিক্রি করে লাভবান হয়, এর ফলেই বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়।

বর্তমানে এই উপজেলার প্রধান কর্মসংস্থান হচ্ছে লটকনের চাষাবাদ। চাষী তোফাজ্জল মিয়া জানান, সাধারণত লটকন গাছের তেমন রোগ - বালাই হয় না। তবে কেবল ছত্রাক সহ কিছু রোগ দেখা দেয়। তাতে ছত্রাকনাশক/কীটনাশক ব্যবহার করলে তা সেরে যায়। যার কারণে হার লটকন চাষ লাভ বেশি হয়।

একটি গাছে কি পরিমাণ লটকন ধরে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছে পাঁচ থেকে দশ মন পর্যন্ত লটকন পাওয়া যায়। আর দিন দিন পরিমাণ বাড়তে থাকে। তিনি আরো বলেন, লটকন বিক্রির জন্য বর্তমানে বাজারে নিতে হয় না দূর দূরান্ত থেকে পাইকাররা এসে নিয়ে যায়। ফলে পরিবহন খরচটাও কম হয়। 


সময় স্বল্পতার জন্য আমরা সেখানে আর বেশি দেরি না করে ১২.৩০ মিনিটে চলে যাই বেলাবো বাজার বড় মসজিদে। এই মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য মসজিদ গুলোর মধ্যে আমার মনে হয় এটি একটি। মসজিদের ভিতরে এবং বাইরে যেমন দৃষ্টিনন্দন কারু কাজ ঠিক তেমনি আশেপাশের পরিবেশটা অনেক সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এটি একটি দেখার মত মসজিদ, যা লটকন বাগান দেখতে চাইলে এটিও দেখে যেতে পারবেন। এ মসজিদের আরো কিছু দৃষ্টিনন্দন ছবি দেখুন। সেখানে আমরা সবাই জুমার নামাজ আদায় করি। 
ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে রোডের পাশেই অবস্থিত হোটেল মাহা।

এটি মরজাল বাস স্ট্যান্ডে অবস্থিত। যেহেতু আমরা অনেক মানুষ ছিলাম সেহেতু আমাদের যাওয়ার আগেই হোটেল কর্তৃপক্ষের সাথে খাওয়ার আইটেম নির্ধারণ করা ছিল। খাবার আইটেমের মধ্যে ছিল মুরগির রোস্ট, ডাল, ভর্তা ও ভাজি। যা ১৫০ টাকায় নির্ধারণ করাছিল। এখানে খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম, গান-গাওয়া ও মজা মাস্তি করে বিকাল ৩.০০ মিনিটে চলে যাই রায়পুরা উপজেলার সাহারখোলা মেঘনা ঘাটে।

পথিমধ্যে হানা দেয় বৃষ্টি, তাতে কি ? ভ্রমন প্রিয় মানুষের কাছে ঝড়,বৃষ্টি কিছুই না। বৃষ্টি পড়ছে বাইকের চাকা চলছে। সবাই ভিজা শরীর,আবার অনেকের কাদা মাটি মিশ্রিত শরীর নিয়ে ঘাটে উপস্থিত হই বিকাল ৪.০০ মিনিটে। সেখানে পৌঁছ মাত্রই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এর মধ্যে কেউ রিসোর্টে ঢুকে পড়ছে আবার কেউ বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা শুরু করছে। তারপর হই-হুল্ল,বৃষ্টিতে ভিজে ফটোশুট, নদীতে গোসল, ফরমালিন মুক্ত সাগর কলা খাওয়া শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। 
অতঃপর বৃষ্টির শেষ হলো, আমাদের বাড়ি ফেরাও শুরু হলো। সারাদিনের এই জার্নি লাইফে একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকবে। এতগুলো বন্ধু-বান্ধব ,এতগুলো বাইক । অবশেষে যে যার মত বাইক নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত হয়ে আমরা যে যার বাসা নিরাপদে আসতে পেরেছি, এর জন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি, আলহামদুলিল্লাহ ।

প্রতিটি টুর আমাদের স্মৃতি হয়ে থাকবে।
নরসিংদী বাইক ট্যুরে আমাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছে আমাদের নরসিংদীর বন্ধু Mostofa Kamal । এজন্য তার কাছে আমরা ক্লাব টিআইবি কৃতজ্ঞ। যদি আপনাদের ইচ্ছে হয় নরসিংদীর লটকন বাগান ঘুরে আসতে কিংবা যে কোন তথ্য ও সহযোগিতা জানতে বা চাইতে আমাদের বন্ধু কে নক করতে পারেন। ইনশাল্লাহ সে সার্বিকভাবে আপনাদের সহযোগিতা করবে।

যেভাবে নরসিংদীর লটকন বাগানে যাবেন

রাজধানী ঢাকা থেকে বাসে নরসিংদী যাওয়া যায়। রাজধানীর গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, আব্দুল্লাহপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন বাসে কাঁচপুর দিয়ে অথবা ডেমরা দিয়ে গাউছিয়া হয়ে নরসিংদীর মরজাল বাস স্ট্যান্ড যেতে পারবেন। সেখানে নেমে অটো রিক্সা করে আশেপাশে অনেকগুলো বাগান আছে ইচ্ছে মতো ঘুরে দেখতে পারবেন।

আর যদি ট্রেনে যান, তাহলে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে মহানগর এক্সপ্রেস কিংবা কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস করে নরসিংদী নামতে পারবেন। নরসিংদী রেল স্টেশন থেকে বোলানগর বাস স্ট্যান্ড থেকে লেগুনা,বাস বা সিএনজি দিয়ে মরজাল বাস স্ট্যান্ড আসতে হবে। সেখান থেকে লটকন বাগান দেখার জন্য একটি রিক্সা ভাড়া নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন।

লটকন বাগানে যাওয়ার আগে যে বিষয়গুলো জানা ও মানা জরুরি

  • বাংলা জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস ইংরেজিতে মে মাসের মাঝামাঝি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত লটকন বাগান দেখার উপযুক্ত সময়।
  • আপনি বুঝতে হবে, আপনি লটকন বাগানে একজন দর্শনার্থী বা মেহমান। সে ক্ষেত্রে বাগান মালিকের অনুমতি ছাড়া লটকনছিড়তে যাবেন না। নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখবেন কারণ লটকন বাগান দেখলেই আপনার লোভ সামলানো কঠিন। সে ক্ষেত্রে আত্মসম্মনের কথা চিন্তা করবেন এবং মালিকের অনুমতি নিয়ে খেতে পারেন।
  • লটকন বাগান গুলো দেখার জন্য বাইকে যাওয়াই ভালো । অনেকগুলো বাগান অনেক ভিতরে বাইকে গেলে আপনি সবগুলো বাগান দেখতে পাবেন। সময় যেমন কম লাগবে তেমনি খরচ কম হবে। কিন্তু রিক্সায় গেলে বাগান গুলো পরিদর্শন করতে রিক্সা ভাড়া যেমন বেশি লাগবে তেমন খরচও বেশি লাগবে আবার সময়ের কারনে আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতেই হয়ত পারবেন না।
  • জুলাই মাসের পরে লটকন কমতে শুরু করে এবং বাগানের সৌন্দর্য কমে যায়। তাই জুলাই মাস শেষ হলে আপনি না যাওয়াই ভালো সে ক্ষেত্রে শুধু  গাছ দেখতে পাবেন লটকন দেখতে নাও পারেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url