ঈদে মিলাদুন্নবী জায়েজ কিনা ও ঈদে মিলাদুন্নবী’র সঠিক ইতিহাস জানুন।
সুপ্রিয় পাঠকগণ আমরা প্রথমে জানবো ঈদ অর্থ কি? ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থ খুশি হওয়া, ফিরে আসা, আনন্দ উদযাপন করা ইত্যাদি। আর মিলাদ শব্দের অর্থ হলো জন্ম তারিখ, জন্মদিন, জন্ম কাল ইত্যাদি।
তাই ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলতে, নবীজির আগমনকে বোঝায়। ঈদে মিলাদুন্নবী বলতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর আগমনী আনন্দ উদযাপন করাকে বোঝায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবী সাঃ এর সময় খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় এমনকি তাবেঈ ও তাবে তাবেঈদের সময়েও ঈদে মিলাদুন্নবী নামে কোন উৎসব ছিল না।
১২ই রবিউল আউয়াল কি মহানবী (সাঃ) জন্মগ্রহন করেছেন ?
ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে আমাদের মুসলমানদের মাঝে নানান মতানৈক্য রয়েছে। আজকে আমরা সে বিষয়ে ক্লিয়ার হবো। হিজরী বর্ষের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল এর ১২ তারিখে ঈদে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মুসলমানরা এই দিনকে ঈদে মিলাদুন্নবী বলে থাকেন। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কাছে এই দিন নবী দিবস নামে পরিচিত।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২ ই রবিউল আওয়ালে জন্মগ্রহণ করেছেন। এমন সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। কারণ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। এটাতে সবাই একমত কিন্তু তিনি কোন তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এটাতে বিভিন্ন ধরনের মতভেদ রয়েছে।
কারণ ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ ১২ই রবিউল আউয়াল ছিল বৃহস্পতিবার এবং ৯ রবিউল আউয়াল হচ্ছে সোমবার। সেই অনুযায়ী বিভিন্ন রকম স্কলারদের মাঝে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে, কিন্তু আরেকটি বিষয় হলো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তেকাল করেন কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল এবারই রবিউল আউয়াল ঈদের মিলাদুন্নবী পালন করা হয়।
ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ঈদে মিলাদুন্নবী প্রচলন শুরু হয়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যা ও জামাতা এবং তার দুই নাতি জন্মদিন এসব মূল প্রবর্তক ছিল খলিফা আল মুয়ীজ্জ লি দিনিল্লাহ । এই সব অনুষ্ঠান তখনও মুসলিম বিশ্বের উইদ্র জায়গাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে পরবর্তীতে ঈদে মিলাদুন্নবীকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি হলেন ইরাক অঞ্চলের আবু সাঈদ কুকবুরি। দুই ঈদের বাইরে কোন দিনকে সামাজিকভাবে উদযাপন শুরু হয় হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শিয়াদের উদ্যোগে।
৩৫২ হিজরীতে বাগদাদের আব্বাসী খলিফার প্রধান প্রশাসক ও রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক বণিক শিয়া শাসক মইজুদ্দৌলা ১০ই মরহুম আশুরাকে শোক দিবস ও জিলহজ মাসের ৮ তারিখ ,"গাদির খম দিবস ঈদ ও উৎসব দিবস হিসেবে পালন করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে এই দুটি দিবস সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। এতে শুধুমাত্র শিয়ারা অংশগ্রহণ করেন।
যিনি ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রবর্তক হিসেবে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি হলেন ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের শাসক আবু সাঈদ মুজাফফর উদ্দিন কুকুবুরি। তিনি প্রথম সুন্নিসহ বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রবর্তন করেন।
সিরাতুন্নবি গবেষক ও ঐতিহাসিকরা তাকেই মিলাদুন্নবীর প্রকৃত উদ্ভাবক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনিই প্রথম এই উৎসবকে বৃহৎ আকারে উদযাপন শুরু করেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই উৎসবের প্রচলন করেন। সে হিসেবে জানা যায়, ৬০৪ হিজরি থেকে আনুষ্ঠানিক মিলাদ উদযাপন শুরু হয় । মিলাদের উপর সর্বপ্রথম কিতাবুল ফি মাউলিদিস সীরা জিল মুনীর নামক গ্রন্থ রচনা করেন স্পেনের অধিবাসী আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান ইবনে দেহিয়া আল কলবি। যিনি ৯০ বছরের দীর্ঘ জীবনে ইসলামী বিশ্বের সর্বত্র ভ্রমণ করেন এবং ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেন।
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষ অবলম্বনকারীরা তাদের মতের স্বপক্ষে দলিল হিসেবে সূরা আলে ইমরানের ৮১ নং আয়াতটি উল্লেখ করে থাকেন। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ”হে প্রিয় রাসূল আপনি স্মরণ করুন ওই দিনের ঘটনা যখন আল্লাহ পাক আম্বিয়ায়ে কেরামদের কাছে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, তোমাদের কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি অতঃপর তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তার প্রত্যয়নকারী রূপে যখন একজন রাসূল আসবেন তখন তোমরা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে।
এছাড়াও পবিত্র কুরআনের সূরা ইউনূসের ৫৭ ও ৫৮ নং আয়াতটিও উল্লেখ করেন, এ আয়াতে কারিমায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ”হে মানব কুল! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং অন্তরসমূহের বিশুদ্ধতা হেদায়েত এবং রহমত ঈমানদারদের জন্য হে নবী আপনি বলুন, আল্লাহর এই অনুগ্রহ ও তার দয়া প্রাপ্তিতে তারা যেন আনন্দ প্রকাশ করে এটা তাদের সব ধন দৌলত সঞ্চয় করা অপেক্ষা শ্রেয়।
ঈদে মিলাদুন্নবী কি বিদআত
বর্তমানে আমাদের মুসলমানদের মধ্যে ঈদে মিলাদুন্নবী জায়েজ নাকি নাজায়েজ এ নিয়ে বহুত আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলছে। ব্যাপারটি নিয়ে আলেম সমাজের মধ্যে রয়েছে দিধা-দ্বন্দ্ব। অনেক আলেম এটাকে সরাসরি বিদআত বলেও ঘোষণা করেছেন।
আবার অনেক আলেম বলেছেন, ছোট পরিসরে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন শরীয়ত সম্মত এবং এটা উদযাপনের সময় ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু না ঘটলে তা পালন করতে সমস্যা নেই। আজকে বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাবিদদের আলোচনা পর্যালোচনা করে দেখব যে ঈদে মিলাদুন্নবী আসলে কি জায়েজ নাকি নাজায়েজ।
ঈদে মিলাদুন্নবী মূলত পালন করা হয় আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর আগমনের উদ্দেশ্যে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, ১২ই রবিউল আউয়াল নবীজি শুধু এই পৃথিবীতে আসেননি, এই দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে পৃথিবী ছেড়ে চলেও গেছেন।
সেই হিসাব করলে জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে হওয়াতে আনন্দ উৎসব পালন করা মোটেও যৌক্তিক কারণ হতে পারে না। নবীজির ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরামগণ ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন খুব দুঃখ করতেন। যেহেতু সাহাবীরা দুঃখ করতেন তাহলে আমরা কিভাবে আনন্দ করি ? এ কারণে অনেক আলেম ঈদে মিলাদুন্নবীর বড় বিরোধী।
বর্তমানে আমাদের সমাজে দেখা যায়, ঈদে মিলাদুন্নবীকে কেন্দ্র করে বাদ্যযন্ত্র, গান-বাজনা, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করে থাকেন, যা সমাজ ও ধর্ম বিরোধী। এই সমস্ত আয়োজন কোনোভাবে ইসলামী বিধান সমর্থন করে না। প্রিয় নবীর মৃত্যু তারিখ নিয়ে কোন আলেমদের মধ্যে বিরোধ নেই তবে ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে জন্মদিন উদযাপনের বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর মতে, ইসলাম গ্রহণযোগ্য নয় এমন কোন কিছু সাথে একত্রে পালন করা ঠিক নয়। তাই আমরা ঈদে মিলাদুন্নবীতে কোন অনুষ্ঠান করব না।
আমি আশা করি ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে আপনাদের বা আমাদের মধ্যে যে জায়েজ নাজায়েজ এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছিল সেটি আজকে আপনাদের মধ্যে পরিষ্কার করতে পেরেছি। তারপরও যদি কেউ না মানতে চান সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। একজন আলেম বা জ্ঞানী হিসেবে আমরা যতটুকু জ্ঞান অর্জন করতে পারি তা ছড়িয়ে দিতে সর্বদা সচেষ্ট থাকি।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url