ফরয গোসল করার নিয়ম-ফরয গোসল না করার শাস্তি

পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ। আমরা সবাই জানি ইসলামে পবিত্র কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পবিত্রতা বলতে সকল প্রকার নাপাকি হতে নিজেকে পবিত্র হওয়া বুঝায়। তেমনি পবিত্র হওয়ার জন্য ফরয গোসল অত্যন্ত জরুরি। ফরয গোসল যত দ্রুত করে পবিত্র হওয়া যায় ততই ভালো। ফরয গোসল করতে অবেহলা বা না করার শাস্তি সম্পর্কে আজকের  টপিক্স এ আলোচনা করা হয়েছে।

ফরয গোসল করার নিয়ম-ফরয গোসল না করার শাস্তি

যাবতীয় হুকুম আহকাম পালন ও পবিত্রতার ফজিলত ও উপকারিতা অনেক। পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ''নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালবাসেন" । তাই আল্লাহ তাহালাকে খুশি ও নিজের পবিত্রতা রক্ষার করার জন্য ফরয গোসল করা উচিত। 

আরো পড়ুনঃ নামায ভঙ্গের কারন সমূহ- যে সব কারনে নামায কবুল হয় না।

পোস্ট সুচিপত্র

পবিত্র থাকার ফজিলত

রাসূল (সা:) বলেন, যখন কোন মুমিন বান্দা ওজু করে এবং সে যখন অজু অথবা ওযুর পানির শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা থেকে সব গুনাহ ঝরে পড়ে যা সে তার দুই চোখ দিয়ে করছিল।

যখন সে তার দুহাত ধোয়, তখন ওযুর পানি অথবা ওযুর পানি শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে তার উভয় হাত থেকে সব গুনাহ বের হয়ে যায়, সে যা তার হাত দিয়ে করেছিল শেষ পর্যন্ত সে তার গুনা থেকে পাক ও পবিত্র হয়ে যায়।

পবিত্রতা অর্জনের জন্য ইসলামের কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। যেমন-গোসল,অজু, খাওয়ার আগে হাত ধোয়া, দাঁত পরিষ্কার রাখা, মেসওয়াক করা, শরীরে ময়লা লাগলে ধুয়ে ফেলা ইত্যাদি। পবিত্রতা আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক জীবন ও ধর্মীয় জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী-স্ত্রী যদি রাতে সহবাস করে তাহলে ভোরে ফজরের নামাজের আগে আগেই এবং দিনে সহবাস করলে পরবর্তী নামাজের আগেই স্বামী-স্ত্রী দুজনে ফরজ গোসল আদায় করা উচিত। মসজিদ ও বলা হয় পর্যন্ত বলা হয়

ফরজ গোসল কি

আমাদের ধর্মীয় জীবনে ফরজ গোসল একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ফরজ মানে বাধ্যতামূলক বা অপরিহার্য একটি বিষয়। এটা অবশ্য আমাদের মানতে হবে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ফরজ গোসলের ব্যাপারে সতর্কতা থাকা উচিত। স্বামী-স্ত্রী তাদের যৌনাঙ্গের পবিত্রতার ব্যাপারে খুবই যত্নবান হতে হবে। স্বামী যেমন তার অঙ্গকে ভালোভাবে ধুয়ে নেবে, যাতে কোন বীর্য আটকে বা লেগে না থাকে। ঠিক একই ভাবে স্ত্রীও নিজের গোপনাঙ্গ ধুয়ে নিতে হবে ভালোভাবে। 

ইসলামে ফরজ গোসলের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, "যদি তোমরা নাপাক হয়ে থাকো তবে গোসল করো" । সূরা মায়েদা:৬

অনেকে ফরজ গোসলের সঠিক নিয়ম জানেনা। আবার জানতে আগ্রহী না কাউকে জিজ্ঞেস করতে সংকোচ অনুভব করে। অথচ ফরজ গোসল নিয়ম না জানার কারণে এবং ঠিকমতো আদায় না করার কারণে অনেক মুসলমানের ফরজ গোসল আদায় হয় না। ফলে তাদের ইবাদত গুলো কবুল হয় না।

আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ! নামাজের ধারের কাছে যেওনা যখন তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বা  নাপাক অবস্থায় থাকো,যে পর্যন্ত না তোমার বুঝে আসে কি করছো এবং যৌন সম্পর্ক করার পরবর্তী অবস্থায় যতক্ষণ না গোসল করেছো । সূরা আন নিসা ৪৩ 

নামাজ পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য, নামাজের বাইরে যে সমস্ত রুকনগুলো আছে। যেমন শরীর, কাপড় খারাপ,নামাজের স্থান অপবিত্র ইত্যাদি। বিষয় গুলো সম্পর্কে হাদিসে আছে যে, অপবিত্র শরীরে,কাপড়ে ও বিছানা পত্রে নামাজ হয় না। মিশকত ২৬২

গোসল ফরজ হওয়ার শর্তাবলী

  • স্বপ্নদোষ বা উত্তেজনা বসত বীর্যপাত হলে ।

  • স্বপ্নের কথা স্মরণ থাকুক বা না থাকুক শরীরের কাপড়ে বা বিছানায় বীর্য চিহ্ন দেখতে পেলে।
  • নারী পুরুষের সহবাসে বীর্যপাত হোক আর না হোক। মহিলাদের মাসিক ঋতুস্রাব-হায়েস বন্ধ হলে বা সন্তান প্রসবের পর যে রক্তচাপ হয় তা শেষ হলে।
  • ইসলাম গ্রহণ করলে বা নব-মুসলিম হলে। স্ত্রী-পুরুষ কারো উত্তেজনার সাথে বীর্য বের হলে 

ফরজ গোসল ছাড়া নামাজ হবে না। যে ব্যক্তির উপর গোসল ফরজ হয়েছে। সেই ব্যক্তি যদি গোসলের সময় একটি ফরয বাদ দেয়, তাহলে সমুদ্র পরিমান পানি দিয়ে গোসল করলেও তার শরীর পবিত্র হবে না।

গোসলের ফরজ সমূহ 

গোসলের ফরজ গুলো হচ্ছে। গোসলের ফরজ তিনটি যথা 

  • একবার কুলি করা ফরজ, 
  • একবার নাকের নরম জায়গায় পর্যন্ত পানি পৌঁছিয়ে পরিষ্কার করা ফরজ।
  • সমস্ত শরীরে পানি পৌঁছানো ফরজ

গোসলের সুন্নত সমূহ।

  • ফরজ গোসলের আগে ইস্তিঞ্জা বা  প্রস্রাব করে নেওয়া
  • গোসলখানায় নোংরা বা তার মধ্যে পায়খানা থাকলে বাম পা দিয়ে প্রবেশ করা।
  • শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া যদি ভিতরে পায়খানা না থাকে
  • উভয় হাত কব্জি সহ তিনবার ধৌত করা।
  • শরীরে বা কাপড়ের কোন স্থানে নাপাকি লেগে থাকলে গোসলে পূর্বে তার তিনবার ধৌত করা।
  •  নাপাকি না লেগে থাকলেও পেশাব পায়খানার লজ্জাস্থান বাম হাত দিয়ে ধৌত করে তা ভালোভাবে পরিষ্কার করা।
  • সুন্নাত তরিকায় নামাজের ওজনে পরিপূর্ণ অজু করা। 
  • যদি গোসলের স্থানে পানি জমে থাকে তাহলে গোসল শেষে অন্যত্র সরে গিয়ে পা ধুয়ে নেওয়া ।
  • ওযুর মাঝে ও শেষে যে দোয়াগুলো আছে তা পড়া সুন্নত । তবে গোসলখানা নোংরা হলে বা সাথে টয়লেট থাকলে গোসল শেষে বাইরে বের হয়ে পড়া উচিত।
  • প্রথমে হাতে পানি নিয়ে মাথার চুলের গোড়ায় ডলাডলি করে পানি পৌঁছাবে।
  • অতঃপর ডান কাঁদে পানি ঢালবে।
  • এরপর বাম কাঁধে পানি ঢালবে।
  • অতঃপর অবশিষ্ট শরীর ভিজাতে হবে।
  • সমস্ত শরীরের উত্তমরূপে তিনবার পানি ঢালবেন যাতে একটি ফসলের গোড়াও শুষ্ক না থাকে।
  • সর্বশেষ সমস্ত শরীর ডলে ডলে ভালোভাবে ধৌত করা।

তবে নদী-পুকুর, খাল-বিল ইত্যাদিতে গোসল করলে কিছুক্ষণ ডুব দিয়ে থাকলে পুরো শরীরে তিনবার পানি ঢালার সুন্নত আদায় হয়ে যাবে।

আরো পড়ুনঃ শরীয়াতের নিয়মে স্বামী-স্ত্রীর সহবাসের নিয়ম-ইসলামী নিয়মে সহবাস

ফরজ গোসল সঠিকভাবে করার নিয়ম

গোসলের পূর্বে প্রস্রাব করে নেওয়া উচিত। ফরজ গোসলের জন্য মনে মনে নিয়ত করা। প্রথমে দুই হাত কবজি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করা। এরপর ডান হাতে পানি নিয়ে বাম হাতে লজ্জাস্থান এবং তার আশপাশ ভালোভাবে ধৌত করা। শরীরে অন্য কোন জায়গায় নাপাকি লেগে থাকলে সেটাও ধৌত করা । এবার বাম হাতকে ভালো করে ধৌত করতে হবে। তারপর বিসমিল্লাহ বলে ওযুর নিয়মের মতো ডান হাতের পানি নিয়ে উভয় হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করা।

তিনবার কুলি করা। তিনবার নাকে পানি দিয়ে , কপাল হতে দুই কানের লতি ও থুতনির্বিশ পর্যন্ত ধৌত করা। তারপর প্রথমে ডান হাত ও পরে বাম হাত দিয়ে তিনবার ধোয়া। আঙ্গুলে আংটি এবং মেয়েদের হাতে , কানে ও নাকে গহনা থাকলে তা নেড়েছেড়ে ভিজিয়ে নেওয়া।  সম্পূর্ণ মাথা মাসেও করা।

অতঃপর প্রথমে মাথায় তিনবার তিন অঞ্জলি পানি ঢেলে, চুলের গোড়ায় খিলাল করে ভালোভাবে পানি পৌছাবে।

এবার সমস্ত শরীর ধোয়ার জন্য প্রথমে, তিনবার ডানে তারপরে তিনবার বামে পানি ঢেলে ভালোভাবে ধৌত করা । যেন শরীরে কোন অংশই বা কোন লোমও শুকনো না থাকে। গোসল এমনভাবে করতে হবে যাতে বগল নাভি ও কানের ছিদ্র পর্যন্ত পানি দ্বারা ভিজে যায়। অতঃপর আবার সমস্ত শরীরে পানি ঢালবে।

সবার শেষে একটু অন্য জায়গায় সরে গিয়ে দুই পা তিন বার ভালোভাবে দ্রুত করতে হবে । মনে রাখতে হবে পুরুষের দাড়ি ও মাথার চুল এবং মহিলাদের চুল ভালোভাবে ভিজাতে হবে। গোসলের সময় মেয়েদের মাথার খোপা খোলার দরকার নেই কেবল চুলের গোয়ায় তিনবার তিন চুল্লি পরিমাণ পানি ভালোভাবে ঢালতে হবে।

এই নিয়মে গোসলের পর নতুন করে আর অজু করার দরকার নেই। তবে ওযু ভেঙ্গে গেলে আবার নতুন করে ওযু করতে হবে। কেননা হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু বলেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ফরজ গোসলের পর আরো অজু করতেন না । তিরমিজি ১০৩, মিশকাত ৪০৯

রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এক মুগ্ধ পরিমাণ (৬২৫ গ্রাম) পানি দিয়ে ওযু করতেন এবং অন্যদিকে (৩১২৫ গ্রাম) মুগ্ধ পরিমাণ বা সোয়া ৩ কেজি পানি দিয়ে গোসল করতেন। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পানি অপচয় করতেন না। মহানবী (সাঃ) পুরুষ হোক আর নারী হোক সবাইকে পর্দার মধ্যে গোসল করতে নির্দেশ করেছেন।

ফরজ গোসল না করার শাস্তি

ফরজ গোসল অবহেলার শাস্তি সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহ তিনি বলেন, একদা আমি আমার এক প্রতিবেশীর জানাজায় যোগদান করি। তার লাশ কবরে নামানোর সময় বিড়ালের ন্যায় একটি অদ্ভুত জানোয়ার কবরের ভিতর।  এবং লম্বা করে লাশ খবর নামতে বাধা সৃষ্টি করতে লাগলো।

সেটাকে তাড়ানোর জন্য সবাই মিলে চেষ্টা করলো কিন্তু কোন প্রকারেই তাকে তাড়ানো সম্ভব হলো না। ফলে অন্যত্র কবর খনন করছে কিন্ত সেখানে গিয়েও জন্তুটি ভয়ানক উৎপাত করতে লাগলো। সেটিকে মারতে গিয়েও সফল হলো না। 

অবশেষে সবাই বাধ্য হয়ে তৃতীয় খবর খনন করলো এবং সেখানে গিয়েও জন্তুটি আরো বেশি উপদ্রব শুরু করলো। তারপর সবাই তাড়াতাড়ি তৃতীয় কবরে তাকে দাফন করলাম। দাফন শেষ করে আমরা সবাই যখন কবর ত্যাগ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই তখন কবর হতে বজ্রপাত বের হয়েছিল। আমি এটার কারন জানার জন্য তার স্ত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তার স্ত্রীর উত্তর দিল সহবাসের পর তিনি ফরজ গোসলে অবহেলা করতেন।  এটার জন্য ওনার ফজরের নামাজ কাজা হয়ে যেত, তার অন্য কোন পাপ আমি কখনো দেখিনি।

অতএব, প্রিয় মুসলিম ভাই-বোনেরা অনগ্রহ করে আমরা উপরের আলোচ্য বিষয়গুলো মেনে চলার চেষ্ট করবো। কবরের কঠিন আযাব হতে যেন আল্লাহ আমাদের সবাই হেফাযত করে, আমিন। পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন। 

আরো পড়ুনঃ উত্তম মৃত্যুর আলামত সমূহ- শহীদি ও সৌভাগ্যবান মৃত্যুর আলামত সমূহ

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url