কোরবানি কি ? কোরবানির গুরুত্ব ও ফযিলত সম্পর্কে জানুন।
মুসলমানদের জীবনে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদুল আযহা একটি পবিত্র দিন। দীর্ঘ এক মাস সিএম সাধনের পর ঈদ-উল-ফিতর পালন করা হয়। অন্যদিকে মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টির জন্য যে কোন হালাল পশু কোরবানি দেওয়ার মাধ্যমে ঈদুল আযহা পালন করা হয়।
প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য কোরবানি তথা ঈদ উল আযহা পালন করা ওয়াজিব। সাহাবায়ে কেরাম নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসুল! কোরবানি কি? টেনে সাবলীল ভাবে এ প্রশ্নের গুরুত্ব ও ফজিলত তুলে ধরেছেন।
পোস্ট সূচিপত্র
কোরবানি কি
উর্দু ও ফার্সিতে কোরবানি শব্দটির ব্যবহার হলেও এটি করব বা কোরবান শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য । কোরবান হলো প্রত্যেক সেই বস্তু যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট অর্জন করা যায়। আর সেখান থেকেই ফার্সি বা উর্দুতে বাংলাতে কোরবানি শব্দটি গৃহীত হয়েছে।
আল্লাহর নিকট্য পাওয়ার আশায় জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কোরবানির নিয়তে উট, গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া বা অন্য কোন হালাল পশুপাখি জবাই করাই হলো কোরবানি। আর এ পশুর পশম যত বেশিই হোক না কেন প্রতিটি পশমের বিনিময়ে রয়েছে একটি করে সোয়াব। হাদিসে পাকে এসেছে-
হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন সাহাবায়ে কেরাম একদিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন হে আল্লাহর রাসূল এই কোরবানি কি ?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন এটা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহিম আলাইহি সালামের সুন্নত।
কোরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত
কোরবানির ইতিহাস অতি প্রাচীন। কোরআনে হাবিল কাবিলের ঘটনায় তার প্রমাণ। ইসলামে প্রথম কোরবানি এটি। হাবিল প্রথম মানুষ যিনি আল্লাহর জন্য একটি পশু কোরবানি করেন। ধর্মীয় বিবরণ থেকে জানা যায়, হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন।
সে সময় আল্লাহর নির্ধারিত শরীয়ত বা পদ্ধতি ছিল এই যে, আকাশ থেকে আগুন নেমে আসবে এবং হাবিলের কুরবানী কবুল হবে। তার জিনিসকে আগুন গ্রহণ করবে। অর্থাৎ আগুন সে জিনিসকে জ্বালিয়ে দিবে।
রাসূল সাল্লাহু সাল্লামকে একবার প্রশ্ন করা হলো হে আল্লাহর রাসূল! কোরবানির মধ্যে কি ফজিলত রয়েছে?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন (কোরবানির জন্তুর) প্রতিটি লোমের (পশমের) পরিবর্তে একটি করে নেকি রয়েছে। তারা আবারো জিজ্ঞাসা করলেন পশুর বেলায় কি হবে? (পশুর পশম তো অনেক বেশি)। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কসমওয়ালা পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে ও একটি করে নেকি রয়েছে। সুবহানাল্লাহ!(মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)
মমিন মুসলমানের জন্য নির্ধারিত দিনে কোরবানি করা মহান আল্লাহর নির্দেশ। কোরআন সুন্নাহর নির্দেশনা ও তাই। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
'’অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড় এবং কোরবানি কর।
(সূরা কাওসার: আয়াত ২)
আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে নামাজ ও কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুটি ইবাদত সবচেয়ে বেশি করেছেন। তিনি যেমন বেশি নামাজ আদায় করেছেন তেমনি বেশি কোরবানিও করেছেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোরবানি করা প্রসঙ্গে আল হাদিসের একাধিক বর্ণনা রয়েছে।
তা হল
”সামর্থ্যবানদের মধ্যে যারা কোরবানি করে না, তাদের প্রতি তিনি এভাবে হুঁশিয়ারি করেছেন”
হাদীস শরীফে এসেছে-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, "সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কোরবানি করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদের ঈদগাহের ধারে কাছেও না আসে।
(ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ, মোসতাদরেকে হাকিম)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন বছর কোরবানি থেকে বিরত থাকেন নি । তিনি কর্মে দ্বারা যেমন কুরবানী করতে অনুপ্রাণিত করেছেন আবার বক্তব্য দিয়ে কোরবানির প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন।
হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে পশু জবেহ করে সে নিজের জন্য জবাই করল আর যে নামাজের পর জবেহ করে তার কোরবানি সিদ্ধ হয়। এবং সে মুসলমানদের তরিকার অনুসারী হয়। (বুখারী শরীফ)
কোরবানি দেওয়ার পর একজন মুসলমানের মন পরিষ্কার হয় এবং পবিত্র হয়। গরিব দুঃখী মানুষের এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কোরবানির গোশত বিতরণের ফলে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ভালোবাসা জাগ্রত হয়। একে অপরের প্রতি গভীর ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছে সহজে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়। মানুষ যত বড় পশু কোরবানি করুক না কেন তার গোস্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না বরং পৌঁছে মনের অবস্থা। কোরবানি দাতা পশু জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করছে কিনা এবং জন্তু ক্রয়ের সময় একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি মনে ছিল কিনা আল্লাহ তাআলা এ বিষয়গুলো দেখেন। কুরবানী মুসলিম সমাজের একটি ঐতিহাসিক ইবাদত।
যুগের পর যুগ ধরে সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজ কোরবানি দিয়ে আসছে। ঈদের দিনগুলোতে সারা বিশ্বের লাখো কোটি পশু কোরবানি হচ্ছে,
আল্লাহ তাআলা কোরবানির মধ্যে বরকত রেখেছেন কোরবানির সম্পর্কে হযরত মির্জার ইবনে সালিম রাদিয়াল্লাহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে সম্ভবত লোকদের সম্বোধন করে বলতে শুনেছি। হে লোক সকল, তোমরা জেনে রাখ প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর প্রতিবছর কোরবানি করা কর্তব্য। আর যার সামর্থ্য নেই তাদের উপর কুরবানী কর্তব্য নয়। কারণ আল্লাহ কারো উপর এমন কোন কাজের দায়িত্ব ছাপিয়ে দেন না যা তার সাধ্যের বাইরে।
(তিরমিজি শরীফ)
এ দ্বারা বুঝা গেল কোরবানি করা অনেক বড় সওয়াবের কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবছরে কুরবানী করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার ১০ বছর জীবনের প্রতি বছরে কোরবানি করেছেন।
(তিরমিজি শরীফ হাদিস শরীফ)
কেয়ামতের দিন কোরবানিকৃত প্রাণী ও তার রুহ, খুর ও সিং সহ সকল কিছু উপস্থিত হবে। তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। কুরবানী শুধু এক আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য হাসিলের জন্যই করা হয়। কেননা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, তুমি তোমার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়া এবং কোরবানি করো।( সূরা কাওসার)
কোরবানি দেওয়ার আগে যদি গোস্ত খাওয়া লোকিকতা অথবা এরূপ কোন হীন স্বার্থ জড়িত থাকে তাহলে সম্পূর্ণ কুরবানি নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমান সময় দেখা যায় কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে শুধু নিজের গৌরব বা ক্ষমতা অথবা টাকার অহংকার দেখানোর জন্য মানুষ কোরবানি করে থাকে । কে কত বড় গরু কিনলো, উট কিনলো, খাসি কিনলো ,কোনটার দাম কত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করার হিট শুরু হয়ে যায়। আর এটাকে বলে লোক দেখানো ইবাদত।
ফলে কোরবানি করার পরও মানুষের মনের কোন পরিবর্তন হয় না। বরং আগের তুলনায় হিংসা, বিদ্বেষ এবং শত্রুতা বৃদ্ধি পায় । আর এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হচ্ছে না। এ কুরবানীর প্রধান উদ্দেশ্যই হাতছাড়া হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে সহীহ নিয়তে কুরবানী করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url