জাহিলি যুগে নারীদের কলুষিত জীবন-আরবের অন্ধকারাচ্ছান্ন যুগের কাহিনী
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্মের পূর্বে আরবের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। নারীদের সম্মান বলতে কিছুই ছিল না। নারীরা ছিলো পুরুষের ভোগের বস্তু। একদিকে সম্ভ্রান্ত এবং অভিজাত পরিবারের জন্য প্রচলিত ছিল এই উৎকর্ষ ব্যবস্থা।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নারী পুরুষের সম্পর্ক এবং মেলামেশার ক্ষেত্রে এমন সব ভিন্ন ব্যবস্থা এবং জঘন্য প্রচলিত ছিল যাকে অশ্লীলতা, পাশবিকতা এবং ব্যভিচার ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত সূত্রে জানা যায়,- অন্ধকার যুগে আরব সমাজে বিয়ের চারটি প্রথা প্রচলিত ছিল।
আরও পড়ুন ঃ ইমাম আবু হানিফার জীবনী-প্রখ্যাত ইমাম আবু হানিফার জীবনী।
পোস্ট সূচিপত্র
- নিয়মিত বিবাহ
- নিকাহে ইসতিবযা
- দলগত বিবাহ
- বিজিত নারীদের সম্ভোগ
- বহুবিবাহ
- অবাধ ব্যাভিচার
- দাস দাসীদের জীবনাচার
- কন্যাদের সাথে ব্যবহার
- ভাই ভাই সম্পর্ক
- সারকথা
নিয়মিত বিবাহ
এর মধ্যে একটি হচ্ছে সেই প্রথা যা বর্তমান যুগেও জনসমাজের প্রচলিত। এই প্রথা অনুসারে বিভিন্ন দিক বিবেচনার পর একজন অভিভাবক তার অধীনস্থদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা হওয়ার পর বর-কনেকে ধার্যকৃত মোহর প্রদান করে বিয়ে করত।
নিকাহে ইসতিবযা
নারী পুরুষের বিবাহের দ্বিতীয় পতাকে বলা হত "নিকাহে ইসতিবযা" । নারী ও পুরুষের মিলনের মুখ্য উদ্দেশ্যে থাকতো জ্ঞানী,গুণী ও শক্তিধর কোন সুপুরুষের সাথে সঙ্গমক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর সন্তান লাভ করা। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যখন কোন মহিলা ঋতুজনিত অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হত তখন তার স্বামী তাকে পছন্দ মত কোন সুপুরুষের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠাতে বলতো।
এই অবস্থায় স্বামী তার নিকট থেকে পৃথক হয়ে থাকতো, কোনোক্রমে তার সাথে সঙ্গমক্রিয়ায় লিপ্ত হতো না। এদিকে স্ত্রীকে দেওয়া প্রস্তাব স্বীকৃতি লাভ করলে গর্ভধারণের সুস্পষ্ট আলামত প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত তার সাথে সঙ্গমক্রিয়ায় লিপ্ত হতে থাকতো। তারপর গর্ভধারণের আলামত সুস্পষ্ট হলে সে তার স্বামীর সাথে মিলিত হতো ভারতীয় পরিভাষায় এ বিয়েকে "নিয়োগ" বলা হতো।
দলগত বিবাহ
তথা কথিত "বিয়ে" নামক নারী-পুরুষের মিলনের তৃতীয় প্রথা মারাত্মক ও জঘন্য একটি ব্যাপার ছিল। এতে ১০ এর চেয়ে কম সংখ্যক পুরুষের সমন্বয়ে একটি দল একত্রিত হতো এবং সকল পর্যায়ক্রমে একই মহিলাদের সাথে সঙ্গম কে লিপ্ত হতো। এর ফলে উক্ত মহিলা গর্ভধারণের পর যথা সময়ে সন্তান প্রসব করত।
সন্তান প্রসবের কয়েকদিন পর সেই মহিলা তার সাথে যারা সঙ্গমক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছিল তাদের সকলকে ডেকে একত্রিত করতো। প্রচলিত নিয়মে বাধ্যগতভাবেই সংশ্লিষ্ট সকলকে সেখানে উপস্থিত করা হতো।তারপর সমবেত সকল লোকদের মধ্যে থেকে একজনকে লক্ষ্য করে বলতো-
হে অমুক! আমার গর্ভজাত এ সন্তান হচ্ছে আপনারই সন্তান। মহিলার ঘোষণা মতে সন্তানটি হতো তারে সন্তান এবং সংশ্লিষ্ট সকলেই তার স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য থাকতো।পতিতাবৃত্তিনারী পুরুষের "বিয়ে ও মিলন" নাম দিয়ে আরও একটি জঘন্য ধরনের অশ্লীল প্রথা জাহিলি যুগের আরব সমাজের প্রচলিত ছিল।
এতে কোন মহিলা কে কেন্দ্র করে অনেক লোক একত্রিত হতো এবং পর্যায়ক্রমে তার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করতো। এরা হচ্ছে পতিতাবৃত্তির পেশা অবলম্বনকারী মহিলা। সুতরাং দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে কোন লোক তাদের নিকট আসলে তারা আপত্তি করত না।
এদের বাড়ির প্রবেশদ্বারে পতিতাবৃত্তির প্রতীক হিসেবে এক ধরনের নিশান দিয়ে রাখা হতো যাতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা নির্দ্বিদিদায় সেখানে আসা যাওয়া করতে পারে। দৈহিক মিলনের ফলে গর্ভধারণের পর যখন কোন মহিলা সন্তান প্রসব করত, তখন তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারী সকল পুরুষকে একত্রিত করা হতো ।
এরপর এমন এক ব্যক্তিকে সেখানে আহবান ও আমন্ত্রণ জানানো হতো, যে মানুষের অবয়র দেখে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। সে ব্যক্তি উপস্থিত সকলের নিরীক্ষণ করে তার বিবেচনা মতো একজনের সাথে সন্তানটির যোগসূত্র সম্পর্ক স্থাপন করে দিত। সে বলতো এই সন্তান আপনার! যাকে লক্ষ্য করে এ রায় দেওয়া হতো, সে তা মেনে নিতে বাধ্য থাকতো।
এভাবে নবজাতকটি একজন পুরুষের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে যেত। সে ওই শিশুটিকে তার নিজের সন্তান বলে মনে করত। যখন আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসুল প্রেরণ করলেন। তখন জাহিলি যুগের সকল ধরনের অশ্লীলতার বৈবাহিক প্রথার অবসান ঘটল।
বর্তমানে ইসলামী সমাজে যে বিয়ে প্রথা প্রচলিত রয়েছে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরব সমাজে সেই ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠিত করেন।
বিজিত নারীদের সম্ভোগ
কোন কোন ক্ষেত্রে আরবের নারী পুরুষদের অন্যরকম সম্পর্কের কথা জানা যায়। তৎকালে অর্থাৎ জাহিলি যুগে নারী পুরুষের সম্পর্ক গড়আর ব্যাপারটি এমন প্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যার তলোয়ারের ধার এবং বল্লমের ফলার সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত লাভ করত।
এতে গোত্রিয় যুদ্ধ বিগ্রহের ক্ষেত্রে বিজয়ী গোত্র বিজিত গোত্রের নারীদের আটকে রেখে যৌন সম্ভোগে ব্যবহার করত। এ সকল মহিলার গর্ভে যেসব সন্তান জন্ম লাভ করত তাদেরকে কোন সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হতো না। সামাজিকভাবে সারা জীবন তাদেরকে ছোট হয়ে থাকতে হতো।
বহুবিবাহ
জাহিলি যুগে একই সাথে একাধিক বা অনির্দিষ্ট সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণের প্রথা প্রচলিত ছিল। একই সাথে আপন দুই বোনকে স্ত্রীর রূপে গ্রহণ করে সংসার করাটা কোন দোষের ব্যাপার ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর এবং পিতা কর্তৃক তারা প্রাপ্ত সৎ মাকেও বিয়ে করার মত জঘন্যত প্রথা তখন প্রচলিত ছিল। স্ত্রীদের অধিকার ছিল পুরুষদের তালাক দেওয়ার কিন্তু এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা ছিল না।
অবাধ ব্যাভিচার
সে আমলে ব্যভিচারের মতো একটি ঘৃণ্য ও জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত হতে প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষকে দেখা যেত। কোন গোষ্ঠী কিংবা গোত্রের খুব অল্প সংখ্যক লোকই এর নৈতিকতা বিরোধী দুষ্কর্ম থেকে মুক্ত থাকতো। অবশ্য এমন কিছু সংখ্যক নারী-পুরুষদেরও চোখে পড়তো, যাদের আভিজাত অনুভূতি ও সম্ভ্রান্ত বোধ এই ঘৃণ্য পাপাচারের পঙ্কিলতা থেকে তাদেরকে বিরত রাখতো। অত্যান্ত দু:সহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে নারীদের জীবন যাপন করতে হতো। অবশ্য দাসীদের তুলনায় স্বাধীন নারীদের অবস্থা কিছুটা ভাল ছিল।
দাস দাসীদের জীবনাচার
সমাজে দাসীদেরকে অত্যন্ত দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করতে হতো। তৎকালীন সমাজে এমন মনিব খুব কমই ছিল, যারা দাসীদের ক্ষেত্রে নানা অত্যাচার ও পাপাচারে লিপ্ত হতো না । এসব অনাচার ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে তাদের কোন লজ্জাবোধ কিংবা অপরাধবোধ সৃষ্টি হতো না।
যেমন হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ "শুনানে আবু দাউদ" এ বর্ণিত আছে একদা এক ব্যক্তি, রাসূল সাঃ কে লক্ষ্য করে বলল- হে আল্লাহর রাসূল! অমুক ব্যক্তি আমার পুত্র। জাহিলি যুগে আমি তার মায়ের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিলাম।
প্রত্যুত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- ইসলামে এমন দাবির কোন সুযোগ নেই কিংবা মূল্য নেই। অন্ধকার যুগের যাবতীয় প্রথা পদদলিত ও বিলুপ্ত হয়েছে। এমন পুত্র তারই গণ্য হবে যার স্ত্রী অথবা দাসী আছে। আর ব্যভিচারের জন্য বরাদ্দ হলো পাথর।
আরও পড়ুন ঃ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী (১)
সাঈদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং ইবনে জামআর মধ্যে জামার দাসিপুত্র আব্দুর রহমান ব্যাপারে যে বিবাদ সংঘটিত হয়েছিল সেটি একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। এই বিষয়টি অনেকেরই জানা কথা।
জাহিলি যুগে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক বিভিন্ন ধরনের ছিল। সে ব্যাপারে ইতোপূর্বে কিছু কিছু আলোচনা করা হয়েছে। তথাপি এমনটি বলা উচিত হবে না যে, সন্তান বাৎসল্যের ব্যাপারে তাদের কিছুটা ঘাটতি ছিল।
নিম্নোক্ত কবিতার চরণটি প্র্ণিধানযোগ্য--
আমার সন্তান আমার কলিজার টুকরো, যারা জমিনের উপর চলাফেরা করছে।
কন্যাদের সাথে ব্যবহার
অন্যদিকে কন্যা সন্তানদের ব্যাপারে নারকীয় দুষ্কর্ম করতে তারা একটুও দ্বিধাবোধ করত না। সমাজের লোক লজ্জা ও নিন্দার ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত অবস্থায় মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হতো। এমনকি অভাব এবং দুর্ভিক্ষের কারণে পুত্র সন্তানদের হত্যা করতে তারা কুন্ঠাবোধ করত না।।
পুত্র সন্তান হত্যার ব্যাপারে যে জনশ্রুতি রয়েছে তার যথার্থতা নির্ণয় বা প্রত্যয়ন করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ যুদ্ধবিগ্রহের সময় স্বপক্ষে শক্তিশালী করা এবং যুদ্ধের জয়লাভ করার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় নিজ নিজ সন্তান সন্তানেরাই অধিকতর নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হত। সেক্ষেত্রে পুত্র সন্তানের সংখ্যাধিক্যই আরববাসীদের কাব্য হওয়ার স্বাভাবিক।
ভাই ভাই সম্পর্ক
যতটুকু জানা যায়, তৎকালীন আরব সমাজের সহধর ভাই, চাচাতো ভাই এবং গোষ্ঠী ও গোত্রের লোকজনদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটি অত্যন্ত শক্ত ও মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর কারণ হলো আরব সমাজ বহু গোত্রে বিভক্ত এবং গোত্রীয় রেষারেষিতে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও তাদের গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধন এর উপর ভরসা করে টিকে থাকতে হতো ।
তাদের বেঁচে থাকার উপায় ছিল এটা। নিরাপত্তা রক্ষার ব্যাপারে জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সামাজিকতার মূলতত্ত গোত্রীয় চেতনা এবং আবেগ অনুভূতিকে সজীব ও সক্রিয় রাখার ব্যাপারে সহায়ক হতো। সাম্প্রদায়িকতা এবং আত্মীয়তা ছিল গোত্রীয় নিয়ম শৃংখলার উৎস। তারা সে উদাহরণকে শাব্দিক অর্থে বাস্তবের রূপদান করত। যেমন,- নিজ ভাইকে সাহায্য করো সে অত্যাচার হোক কিংবা অত্যাচারিত।
সারকথা
জাহিলি যুগে আরবের সামাজিক অবস্থার স্বার্থতা বলতে গেলে, শুধু এটুকুই বলতে হয় যে স্থিরতা এবং কূপুমুন্ডকতাই সমাজ জীবনের প্রধানত বৈশিষ্ট্য। অজ্ঞতা, অশ্লীলতা , স্বেচ্ছাচারিতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। সমগ্র সমাজ অসত্য ও অন্যায়ের নিকট সত্য ও ন্যায় হয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণরূপে পরাজিত। সাধারণ মানুষকে জীবন যাপন করতে হতো পশুর মত।
বাজারের পণ্যের মতো করা হতো মহিলাদের। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের সাথে ব্যবহার করা হতো মাটি ও পাথরের মত। গোত্র কিংবা রাষ্ট্র যাই বলা হোক না কেন, প্রশাসনের মূল ভিত্তি ছিল ”জোর যার মুল্লুক তার” বৃত্তির উপর। প্রশাসন পরিচালিত হতো শক্তিধরদের স্বার্থে। দুর্বলতার শ্রেণী ও সাধারণ লোকজনের কল্যাণের কথা কম্মিনকালেও চিন্তা করা হতো না।
প্রজাদের নিকট থেকে আদায়কৃত অর্থ-সম্পদ কোষাগার ভরে তোলা হতো এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে অন্য দলের মহড়া এবং যুদ্ধ বিগ্রহের উদ্দেশ্যেই তা সংরক্ষিত হতো।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url