পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব-মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)- এর জীবনী। (পর্বঃ ১)

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। প্রত্যেকটা মুসলমানের কাছে তিনি প্রিয় নবী হিসেবে পরিচিত। হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী পাঠ করলে মহানবীর আদর্শ জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে । নবীজির জীবনী জানা থাকলে আমরা আরো ভালোভাবে ইসলামকে জানতে পারবো, আরো সুন্দরভাবে ইসলামকে মানতে পারবো। 

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর জীবনী পাঠের মাধ্যমে মানবতার শিক্ষা রয়েছে। শুধু মুসলিম না মানুষ হিসেবে সকল ধর্মের মানুষের উচিত মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনী পাঠ করা।

পোস্ট সুচিপত্র

মহানবীর জন্মের পূর্বে আরবের সামগ্রিক অবস্থা ঃ

মক্কা হচ্ছে পৃথিবীর নাভিস্থল। কোরআনে একে উম্মুল কুরা বা আদি জনপদ বলা হয়েছে। মক্কা নগরী তিন দিকে সাগর বেষ্টিত প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গমাইল ব্যাপী আরব উপদ্বীপ কেবল পৃথিবীর মধ্যে স্থলে অবস্থিত নয় বরং এটি তখন ছিল চতুর্দিকের সহযোগস্থল ও ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র ভূমি। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মের পূর্বে আরবের অবস্থা কেমন ছিল তা নিচে আলোচনা কর  হলো।

১. রাজনৈতিক অবস্থা ঃ

এ সময় আরবের দক্ষিণ অংশে ছিল হাফসার সাম্রাজ্য, পূর্ব অংশে ছিল পারসিক সাম্রাজ্য এবং উত্তরাংশে ভূখণ্ড সমূহ ছিল অমুক সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে। সম্রাট শাসিত এসব অঞ্চলের অধিবাসীগণ সবাই ছিল ধর্মের দিক দিয়ে খ্রিস্টান। যদিও প্রকৃত ধর্ম বলতে সেখানে কিছুই ছিল না। মক্কা ও মদিনা সহ আরবের বাকি ভূখণ্ডের লোকেরা স্বাধীন ছিল।

তাদের সৎসাহস, আমানতদারি, সত্যবাদিতা, কাব্য প্রতিভা,স্মৃতিশক্তি, অতিথি পরায়ণতা, ছিল কিংবদন্তি তুল্য। বছরের চার মাস তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। মক্কার লোকেরা ইহুদি বা খ্রিস্টান ছিল না ।তারা নিজেদেরকে ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম এর একান্ত অনুসারী হিসেবে বলতো। মক্কা ছিল সমগ্র আরব্য খন্ডের কেন্দ্রবিন্দু এবং সম্মান ও মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয়। 

সে কারণে খ্রিস্টান রাজারা এর উপরে দখল কায়েম করার জন্য বারবার চেষ্টা করত। এক সময় ইয়েমনের নরপতি আব্রাহা নিজ রাজধানীতে স্বর্ণ-রৌপ্য দিয়ে কা'বা গৃহে আদলে একটি সুন্দর গৃহ নির্মাণ করেন এবং সবাইকে সেখানে হজ করার নির্দেশ জারি করেন কিন্তু সাড়া দেয়নি বরং কেউ একজন সেখানে পায়খানা করে আসে।

এতে সেই ক্ষিপ্ত হয়ে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্য বাহিনী ও হস্তি বাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান করে কাবা গৃহকে ধ্বংস করার জন্য। অবশেষে আল্লাহর গজবে তিনি নিজে তার সৈন্য সামন্ত সহ ধ্বংস হয়ে যান। এতে মক্কার সম্মান ও মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায় এবং এই ঘটনা বণিকদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর জন্মের মাত্র ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে এই অলৌকিক ঘটনা ঘটে। মূলত এটা ছিল শেষ নবীর আগমনের আগাম শুভ সংকেত।

২. মক্কার ধর্মীয় অবস্থা ঃ

মক্কার লোকেরা মূলত হযরত ইসমাইল আলাই সাল্লাম এর বংশধর ছিল এবং তারা জন্মগতভাবেই তাওহীদ রিসালাত ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। তারা ka'ba গৃহ কি যথার্থভাবেই আল্লাহর গৃহ বা বাইতুল্লাহ বলে বিশ্বাস করত এবং তার রক্ষণাবেক্ষণও তত্ত্বাবধান করত। তারা এখানে নিয়মিতভাবে তাওয়াফ সাI,হজ করত এবং বহিরাগত হাজীদের নিরাপত্তা ও পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত।

কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত কোন নবী না আসায় শয়তানি প্রচারণায় তাদের সমাজনেতা ও ধনিক শ্রেণীর অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় এবং একসময় তাদের মাধ্যমেই মূর্তি পূজার (শিরকের) সূচনা হয়, যেভাবে ইতিপূর্বে নূহ নবীর সমাজে হয়েছিল।

ক) বিদ'আতের প্রচলন ঃ

মূ র্তি পূজা করা সত্ত্বেও তারা ধারণা করত যে, তারা দ্বীনে ইব্রাহিমের উপরে দৃঢ়ভাবে কায়েম আছে। কেননা আমর বিন লোহাই তাদের বুঝিয়েছিলেন যে, এগুলোই ইব্রাহিমই দ্বীনের বিকৃতি নয় বরং বিদাতের হাসানাহ" অর্থাৎ ভালো কিছু সংযোজন মাত্র। এজন্য সে বেশ কিছু ধর্মীয় রীতি-নীতি আবিষ্কার ও চালু করেছিল। যেমন:-

১। তারা মূর্তির পাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহবান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয়-বিনয় করে প্রার্থনা জানাত তারা ধারণা করত যে, এই মূর্তি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (জুমার  ৩৯/৩)  এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে । (ইউনুস ১০/১৮)

২। তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ করত, তাওয়াফ করত, তার সামনে প্রণত হতো ও সিজদা করত।

৩। তারা মূর্তির জন্য নযর-নেয়াজ নিয়ে আসতো। সেখানে মূর্তির নামে কোরবানি করতো (মায়েদাহ ৫/৩)

দ্বীনি ইব্রাহিমীতে উপরোক্ত শিরক ও বিদ'আত সমূহ চালু করার পরেও তাদের অহংকার ছিল এই যে,

১। আমরা ইব্রাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দ্বীনে হানীফ- এর খাঁটি অনুসারী। তারা কাবা গৃহের সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধায়ক। অতএব তাদের সমকক্ষ আরব ভূখণ্ডে কেউ নেই। তাদের এই বড়ত্বের ও আভিজাত্যের অহংকার এতদূর পৌঁছে গিয়েছিল যে, তারা যেহেতু সবচেয়ে বড় ধার্মিক  ও বড় পীর” অতএব তাদের পক্ষে ’হারাম’-এর সীমানার বাইরে কোন ’হালাল’ এলাকায় যাওয়াটাই মর্যাদার নয়। 

তারা যেহেতু ’ক্বাত্বীন’ বা আল্লাহর বাসিন্দা ,সেকারনে তারা হজ্জের মৌসুমে মুজদালিফায় অবস্থান করত।  যা ছিল হারাম এলাকার অভ্যন্তরে। হারামের বাইরে হওয়ার কারণে তারা আরাফাতের ময়দানে যেত না বা সেখানে থেকে মক্কায় ফিরে আসা অর্থাৎ ত্বাওয়াফে এফাযাহ করত না । যা ছিল হজ্জের সবচেয়ে বড় করুন। তারা মুযদালেফায় অবস্থান করতো ও সেখান থেকে মক্কায় ফিরে আসতো। সেজন্য আল্লাহর নির্দেশ দেন,-

অতঃপর তোমরা ঐখান থেকে ফিরে এসো ত্বাওয়াফের জন্য, যেখান থেকে লোকেরা ফিরে আসে । (অর্থাৎ আরাফার থেকে) (বাকারা ২/১৯৯)

২। এতদ্ব্যতীত তারা নিজেরা ধর্মীয় বিধান রচনা করেছিল যে, বহিরাগত হাজীগণ মক্কায় এসে প্রথম তাওয়াফের সময় তাদের পরিবেশিত ধর্মীয় কাপড় পরিধান করবে । সম্ভবতঃ এটা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ দুষ্ট  বিদা’আত ছিল। যদি কেউ (আর্থিক কারণে বা অন্য কারণে ) তা সংগ্রহে ব্যর্থ হয় তবে পুরুষেরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে এবং মেয়েরা সব কাপড় খুলে রেখে কেবল ছোট্ট একটা কাপড় পড়ে তাওয়াফ করবে এতে তাদের দেহ এক প্রকার নগ্নই থাকতো এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন,-

 হে বনি আদম! প্রতিবার মসজিদে উপস্থিত হওয়ার সময় তোমাদের পোশাক পরিধান করো । (আ’রাফ  ৭/৩১)

৩। তারা এহরাম পরিহিত অবস্থায় স্ব স্ব বাড়ীর সম্মুখ  দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। কিন্তু বাকি আরবরা সকলে স্ব স্ব বাড়ীর  পিছন দিকের  সরু পথ দিয়ে গৃহে প্রবেশ করবে। এভাবে তারা তাদের ধার্মিকতার ক্ষেত্রে বৈষম্যগত শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব সারা আরবের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ-

‘আর পিছনের দিক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোন মঙ্গল নেই বরং মঙ্গল রয়েছে আল্লাহকে ভয় করার মধ্যে। তোমরা ঘরে প্রবেশ কর সম্মুখ দরজা দিয়ে। (বাকারা  ২/১৮৯)

৩. মদিনায় ইহুদি নাসারাদের অবস্থা:

অপরপক্ষে যারা ইহুদী-নাছারা ছিল, যারা প্রধানত: মদিনায় বসবাস করত; যারা অত্যাচারী রাজা বখত নসর কর্তৃক কেনান (ফিলিস্তিন) থেকে উৎখাত হওয়ার পরে ইয়াসরিবে (মদিনায়) এসে বসবাস শুরু করেছিল এই উদ্দেশ্য যে, তারা বায়তুল মুকাদ্দাস হারিয়েছে। অতএব তারা এখন বায়তুল্লাহর নিকটব্তী থাকবে এবং নিয়মিত হজ্জ ও ওমরাহর মাধ্যমে পরকালীন পাথেয় হাসিল করবে।

দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল যে, আখেরী নবীর আবির্ভাব যেহেতু মক্কায় হবে এবং তার আবির্ভাবের সময় আসন্ন, সেহেতু তারা দ্রুত তার দ্বীন কবুল করবে এবং তার নের্তৃত্বে আবার বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করবে। তবে তাদের ধারনা ছিল এই যে, আখেরী নবী অবশ্যই তাদের বংশধর থেকেই হবেন। কিন্ত তা না হওয়াতেই হল যত বিপত্তি। তাদের ধর্ম ও সমাজ নেতারা ভক্তদের কাছে ‘রব’- এর আসন দখল করেছিল।

৪. আরবের সামাজিক অবস্থাঃ

ক) নারীদের অবস্থা ঃ

ততকালীণ আরবে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন বসবাস করত। সেখানকার অভিজাত শ্রেণীর লোকদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খুবই উন্নত ছিল। পুরুষ প্রধান সমাজ ব্যবস্থা থাকলেও নারীদের ছিল মর্যাদাপুর্ণ অবস্থান। পরিবারে পুরুষ ও মহিলাদের পারস্পারিক সম্পর্ক ছিল মর্যাদা ও ন্যায় ভিত্তিক ব্যবস্থার উপরে প্রতিষ্ঠিত।

অপরপক্ষে সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেনীর আরবদের মধ্যে ছিল এর বিপরীত চিত্র। তাদের মধ্যে চার ধরনের বিবাহ চালু ছিল। এক ধরনের ছিল অভিজাত শ্রেনীর মত পারস্পারিক সম্মতি ও মোহরানার বিনিময়ে বিবাহ পদ্ধতি। কিন্ত বাকি তিনটি পদ্ধতিকে বিবাহ না বলে স্পষ্ট ব্যভিচার বলা উচিত।

৫. গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থা ঃ

আরবদের সামাজিক ব্যবস্থা গোত্র প্রধান হওয়ার কারণে বংশীয় ও আত্মীয়তার সম্পর্ককে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো। মারামারি ও হানাহানিতে জর্জরিত উক্ত সমাজে  কেবল গোত্রীয় ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনের উপরে নির্ভর করেই তাদের টিকে থাকতে হয়। ন্যায়-অন্যায় সবকিছু নির্নীত হত গোত্রীয় স্বার্থের নিরিখে। আজকালকের কথিত গনতান্ত্রিক  রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় যে উৎকট দলতন্ত্র আমরা লক্ষ্য করছি, তা জাহেলি আরবের গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অনেকটা তুলনীয়।

গোত্র সমূহের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। সেকারন তারা অধিক সংখ্যায় পুত্র সন্তান কামনা করত। অধিক সংখ্যক ভাই ও পুত্র সন্তানের মালিককে সবাই সমীহ করত। যুদ্ধে পরাজিত হলে নারীদের বেইযযতি ও তাদের লূট করে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে অথবা দারিদ্রের কারনে অনেকে কন্যা সন্তানকে শিশুুকালেই হত্যা করে ফেলত।

মক্কায় ‘দারুন নাদওয়া’ ছিল বিখ্যাত। তাদের মধ্যে মদ্যপানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। যুদ্ধ ও পেশীশক্তিই বিজয় লাভের মানদন্ড ছিল। আরবের সামাজিক অবস্থাকে এক কথায় বলতে গেলে ’জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে পারিচালিত হত। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা তার চাইতে মোটেই উন্নত নয়।

৬. অর্থনৈতিক অবস্থা ঃ

ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। ত্বায়েফ, সিরিয়া, ইয়ামন প্রভুতি উর্বর এলাকা ছাড়াও অন্যত্র পশু-পালন জনগনের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল। উট ছিল বিশেষ করে দূরপাল্লার সফরের জন্য একমাত্র স্থল পরিবহন। মক্কার ব্যবসায়ীগন শীতকালে ইয়ামনে ও গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় দূরপাল্লার ব্যবসায়িক সফর করত। আর্থিক লেনদেনে সুদের প্রচলন ছিল। 

গৃহের আঙিনায় বসে সূতা কাটার কাজে অধিকাংশ আরব মহিলাকে দেখা যেত। মক্কা-মদীনায় গমের আবাদ ছিল না। আমীর মু’আবিয়ার খেলাফত কালে প্রথম সিরিয়া থেকে মদীনায় গম রফতানী করা হয়। খেজুর বাগান ব্যাপক হারে দেখা যেত। খেজুর ছিল তাদের অন্যতম প্রধান উপজীবিকা।

নিখান পুজিবাদী অর্থনীতি চালু ছিল। যার ফলে সমাজে একদল উচ্চবিত্ত থাকলেও অধিকাংশ লোক বিত্তহীন ও মানবেতর জীবন যাপন করত। আজকের বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এর চেয়ে মোটেই উন্নত নয়। আরবীয় সমাজে উচ্চবিত্ত লোকদের মধ্যে মদ-জুয়া ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেখানে বিত্তহীনরা দাস ও দাসীরুপে বিক্রয় হত ও মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হত।

মহানবী (সাঃ) এর জন্ম ও বংশ পরিচয় ঃ

মহানবী (সাঃ) ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশে ভুমিষ্ঠ হন। ২০ এপ্রিল ওনার জন্ম তারিখ। আরবি হিজরি সাল অনুযায়ী ওনার জন্ম তারিখ নিয়ে নানান মতবাদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন , রবিউল আউয়ালের ৮ তারিখ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)  জন্মগ্রহন করেন। অধিকাংশ হাদিস বিশারদ একে বিশুদ্ধ বলেছেন। 

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)  এর জীবনী লেখকদের মধ্যে ইবনে ইসহাক প্রথম সারির জীবনীকার। তিনি বলেন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হাতিবাহিনীর ঘটনার বছর ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহন করেন। আধুনিক যুগে সিরাত বিষয়ক গ্রন্থ ‘আর রহিকুল মাকতুম’- এ নামক এসছে। সায়িদুল মুরসালিন মক্কায় বনি হাশিমের ঘাটিতে সোমবার সকালে ৯ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহন করেন, যে বছর হাতির ঘটনা ঘটে। 

সে দেশের বাদশাহ আনু শিয়ার ক্ষমতা গ্রহনের ৪০ বছর পুর্ণ হয়। তাফসিরে মাআরেফূল কোরআন প্রণেতা' মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহঃ) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)  এর জন্ম তারিখ সম্পর্কে আরো কিছু অভিমত উল্লেখ করেছেন,- এ বিষয়ে সবাই একমত যে নবী করিম (সাঃ)  এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার দিন হয়েছিল। 

কিন্ত তারিখ নির্ধারনে চারটি বর্ণনা প্রসিদ্ধ আছে। - ২, ৮, ১০, ও ১২ রবিউল আউয়াল। এর মধ্যে হাফিজ মুগলতাই (রাহঃ) ২ তারিখের বর্ণনাকে গ্রহন করে অন্য বর্ণনাগুলোকে দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্ত প্রসিদ্ধ বর্ণনা হচ্ছে ১২ তারিখ।

গবেষক মাহমুদ পাশা জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে ৯ তারিখ গ্রহণ করেছেন । এটি সবার মতের বিপরীত ও সূত্রবিহীন উক্তি। যেহেতু চাঁদ উদয়ের স্থান বিভিন্ন, তাই গণনার উপর এতটুকু বিশ্বাস ও নির্ভরতা জন্মায় না যে তার উপর ভিত্তি করে সবার বিরোধিতা করা যাবে।

মহানবীর জন্ম তারিখ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দিন হিসেবে সোমবার সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। কারণ জীবনচরিত রচয়িতরা একমত যে, রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে সোমবার দিন মহানবী (সাঃ) এর জন্ম । আর এই সোমবার ৮ অথবা ৯ কিংবা ১২ - এটুকুতেই হিসাবের পার্থক্য রয়েছে মাত্র। 

রাসূল (সাঃ) এর জন্মের সময় যে অলৌকিক ঘটনা সমূহ ঘটেছিল ঃ

বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও তার ওপর নাযিল হওয়া ধর্ম বা শরিয়তও সবচেয়ে পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ। আর েএই ধর্ম কিয়ামত পর্যন্ত বা বিশ্বের শেষ দিন পর্যন্ত টিকে থাকবে ও শক্তিশালী হয়ে থাকবে। অন্য নবী-রাসূলরা এসেছিলেন বিশেষ জাতি ও বিশেষ সময়ের জন্য। কিন্ত ইসলম এসেছে সব মানুষ ও জিনের জন্য েএবং কিয়ামত পর্যন্ত তা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ধর্ম।

  • ইমাাম সাদিক রাঃ বলেছেন, শয়তান বা ইবলিস অতীতে সপ্তম আকাশে পর্যন্ত যেতে পারত। অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য সে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত যেত। কিন্ত হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্মের পর থেকে চতুর্থ আকাশের ওপরে ওঠা তার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এরপর যখন বিশ্বনবী (সাঃ) জন্ম নেন তখন তার জন্য সব আকাশই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। শয়তান কে আকাশের দরজাগুলো থেকে ধুমকেতু দিয়ে বিতাড়ন করা হয়।
  • যে ভোর বেলায় মহানবী জন্ম নেন, সেদিন বিশ্বের সবগুলো মূর্তি মাটির দিকে নত হয়ে পড়ে।
  • সেদিন পারস্যের রাজার বিশাল প্রাসাদের বারান্দা কেপে ওঠে এবং ছাদের ১৪টি প্রাচীর ধ্বংস হয়ে পড়ে।
  • সেদিন পারস্যের সভে অঞ্চলের হ্রদটি তলিয়ে শুকিয়ে যায় । বহু বছর ধরে হ্রদটিকে পূজা করা হতো।
  • সামাভে অঞ্চলে ( কুফা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী) পানির প্রবাহ শুরু হয়। অথচ এর আগে বহূ বছর ধরে সেখানে কেউ পানি দেখেনি।
  • পারস্যের শিরাজ শহর সংলগ্ন অগ্নি উপসনালয়ের আগুন সেই রাতে নিভে যায়। অথচ ওই আগুন এক হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত ছিল।
  • সেই রাতে হিজাজ বা বর্তমান সৌদি আরব থেকে একটি আলো দৃশ্যমান হয় এবং তা পূর্বাঞ্চলসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ্বনবীর মাতা মা আমিন (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম, আমার পুত্র জন্ম নিয়েই তার হাতগুলোকে মাটিতে রেখে মাথা আকাশের দিকে তুলে এবং চারদিকে তাকায়। এরপর তার থেকে একটি নূর বা আলো ছড়িয়ে পড়ে ও সে আলোয় সব কিছু দৃশ্যমান হয়। সেই আলোয় সিরিয়ার (রোমানদের) প্রাসাদগুলো দেখলাম এবং সেই আলোর মধ্যে একটি শব্দ শুনলাম , যাতে বলা হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষকে জন্ম দিযেছ, তাই তার নাম রাখ ‘মুহাম্মদ’।

আমিরুল মু’মুনীন হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনে, সে রাতে তথা রাসূল সাঃ জন্মের রাত পুরো দুনিয়া আলোকিত হয়। প্রতিটি পাথর  ও মাটির টুকরো এবং বৃক্ষ বা গাছ হেসেছে। আর আকাশ ও জমিনের সব কিছু আল্লাহর তাসবিহ বা আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করেছে।

মহানবীর শৈশব ও কৈশোরকাল ঃ

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) শৈশব বয়স থেকেই ছিলেন চিন্তাশীল। তিনি তার শৈশবকাল থেকেই সমাজের ও মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে দুঃখ, কষ্ট, ক্ল্যাশ নিয়ে চিন্তা করতেন। এই চিন্তাধারাই তাকে পরবর্তীতে মহামানব হতে সাহায্য করেছিল। তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা । তিনি একমাত্র মানব যে কখনো মিথ্যা কথা বলেননি।

বনি সা'দ গোত্রে অবস্থান ঃ

তৎকালীন আরবের রীতি ছিল যে, তারা মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়া বেড়ে ওঠার মাধ্যমে সন্তানের সুস্থ দেহ সুঠাম গড়ন তৈরির জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন মহিলাদের কাছে দিয়ে দিতেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফেরত নিতেন। এর অন্যতম কারণ ছিল বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিক্ষা করা। এ রীতি অনুসারে মোহাম্মদকেও হালিমা বিন্তে আবু জুবায়ের এর হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। 

মহানবী এতিম বিদায় প্রথমে কোন নারী ওনাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য নিতে চায়নি। কিন্তু হালিমা অন্য কোন শিশু সন্তান না পাওয়ায় এই এতিম শিশুটিকে গ্রহণ করেন। কিন্তু এ শিশুকে ঘরে আনার পর দেখা যায় হালিমার সচ্ছলতা ফিরে আসে এবং তারা শিশু পত্রকে সঠিকভাবে লালন পালন করতে সমর্থ হন। তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য- 

শিশুমোহাম্মদ কেবল হালিমার একটি স্তনে পান করতেন এবং অপরটি তার ওপর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। দুই বছর লালন পালনের পর হালিমা শিশু মোহাম্মদকে আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। কিন্ত এর পরপরেই মক্কায় মহামারী দেখা দেয় এবং শিশু মুহাম্মদকে হালিমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। হালিমাও চাচ্ছিলেন শিশুটিকে ফিরে পেতে। এতে তার আশা পূর্ণ হলো।

মাতৃবিয়োগ ঃ

এই ঘটনার পরই হালিমা মুহাম্মদকে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়স পুর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি মায়ের সাথে কাটান। এই সময় একদিন আমিনার ইচ্ছা হয় ছেলেকে নিয়ে মদীনায় যাবেন। সম্ভবত কোন আত্মীয়ের সাথে দেখা করা এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করাই এর কারন ছিল । আমিনা ছেলে শ্বশুর এবং দাসী উম্মে আয়মনকে নিয়ে ৫০০ কি.মি পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌছেন। তিনি মদীনায় একমাস সময় অতিবাহিত করেন। একমাস পর মক্কায় ফেরার পথে আরওয়া নামক স্থানে এসে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

দাদার মৃত্যু ঃ

মাতার মৃত্যুর পর দাদা আবদুল মোত্তালিব শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে মক্কায় পৌছেন। েএর পর থেকে দাদাই মুহাম্মদকে দেখাশোনা করতে থাকেন। তিনি শিশু নবীকে নিজের সন্তানদের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন।  ইবনে হিশাম তার সীরাত গ্রন্থে লিখেছেন, আবদূল মোত্তালিবের জন্য কাবাঘরের ছায়ায় বিছানা পেতে দেয়া হতো। তার সব সন্তান সেই বিছানার চারদিকে বসতেন। বালক মোহাম্মদ গেলে বিছানায়ই বসতেন। বালক মোহাম্মদ কাজকর্ম তাকে আনান্দ দিতো। মুহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন তখন তার দাদাও মারা যান। মৃত্যূর আগে তিনি মুহাম্মদ দায়িত্বে তার সন্তান আবু তালিবের নিকট দিয়ে যান।

সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা ঃ

আবু তালিবের বাড়িতে মুহাম্মদ (সাঃ) বেড়ে উঠতে থাকেন।  চাচা ওনাকে অসম্ভব আদর করতে থাকেন এবং মুহাম্মদ (সাঃ) চাচাকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতে থাকেন। যেমন- তিনি অন্যান্য বালকদের মতো চাচা আবু তালিবের ছাগল চড়াতেন । কিন্ত এ সময় থেকে ওনাকে চিন্তাশীল মনে হতো । আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সফরে যেতেন। মমুহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স যখন ১২ বছর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়ায় যেতে বায়না ধরেন। প্রগাঢ় মমতার কারনে চাচা আবু তালিব ওনাকে নিষেধ করতে পারলেন না। 

যাত্রাপথে বসরা পৌছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। কথিত আছে, শহরটিতে জারজিস নামে এক ইয়াহুদি পাদ্রী ছিলেন। যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গীর্জা হতে বাহিরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারি করেন। এ সময় তিনি বালক মুহাম্মদ কে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। কারণ তিনি তার অন্তর দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য করেন যে, সব গাছপালা ও পাথর এ বালকটিকে সেজদা করছে। 

তিনি স্বগতোক্তি করেন, এতো সেই সাইয়েদুল মুরসালীন, অতীতের সমস্ত নবী যার আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করে গেছেন। তিনি আাবু তালিবকে মুহাম্মদকে সিরিয়ায় নিয়ে যেতে নিষেধ করেন। কারন সেখান কার ইহুদীরা ওনার ক্ষতি করতে পারে। পাদ্রীর কথা শুনে মুহাম্মদকে ভৃত্যের মাধ্যেমে পুনরায় মক্কায় পাঠিয়ৈ দেওয়া হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url