অতিরিক্ত ওজনের কুফল-অতিরিক্ত ওজন কমানোর উপায়
অতিরিক্ত ওজন
অতিরিক্ত ওজন ও স্থুলতাকে আমরা একটি সাধারণ শারীরিক সমস্যা মনে করি। কিন্ত স্থুলতা বা অধিক মোটা হওয়া কোন সাধারণ সমস্যা নয় বরং একটি মারাত্মক প্রাণঘাতী সমস্যা। একে আমরা নীরব ঘাতকও বলতে পারি।
কারন অতিরিক্ত ওজন বা স্থুলতা আমাদের দেহে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, আর্থ্রাইটিস ও ক্যান্সারসহ অসংখ্য রোগের সৃষ্টি করে এবং আমাদের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। বর্তমানে বিশ্বের মোট জনংসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ অর্থ্যাৎ প্রায় ১০০ কোটির বেশি মানুষ অতিরিক্ত ওজন বহন করছে।
আর এই অতিরিক্ত ওজনই কালক্রমে আমাদের অসুস্থ করে দিছে এবং ঠেলে দিচ্ছে অকাল মৃত্যুর দিকে।
আরও পড়ুনঃ- পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব কেন হয়-পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব হলে করণীয়
পোস্ট সূচিপত্র
- অতিরিক্ত ওজন ও স্থুলতা কেন হয়
- আধুনিক খাদ্যাভ্যাস ও অতিরিক্ত ওজন :
- কিভাবে বুঝবেন আপনি অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী :
- স্থুলতা ও অধিক ওজনের অধিকারী হওয়ার কুফল
- স্থুলতা ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া
- অস্বাভাবিক ওজন থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েকটি কার্যকর পদ্ধতি
- ব্যায়াম
- সুষম খাদ্য গ্রহন
- পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান
- পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম
অতিরিক্ত ওজন ও স্থুলতা কেন হয়
আমাদের দেহে অনেক চর্বি কোষ রয়েছে। যেখানে আমাদের গ্রহনকৃত চর্বি জমা থাকে এবং প্রয়োজনের সময় এ সকল চর্বি ভেঙ্গে আমাদের দেহে শক্তির যোগান দেয়। একটি মানব শিশু জন্ম গ্রহন করার পর থেকে ৬ বৎসর বয়স পর্যন্ত চর্বি কোষ সংখ্যা ও আয়তনে খাবারের মাধ্যমে চর্বি ও ক্যালরি গ্রহনের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে আয়তনে বাড়তে থাকে।
আমাদের দেহ কে সচল রাখতে খাবার গ্রহন একান্ত জরুরী। কিন্ত সেই খাবার গ্রহণ অবশ্যই একটি সঠিক নিয়ম অনুযায়ী হওয়া উচিত। আমরা যেসকল খাবার গ্রহন করি সেসকল খাবার দেহের অভ্যন্তরস্থ কোষে গিয়ে বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে এবং আমাদের স্বাভাবিক জৈবিক কার্যাবলী নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে।
একজন পূর্ণ বয়স্ক স্বাভাবিক মানুষের প্রতিদিন গড়ে ২৪০০ ক্যলরি শক্তির প্রয়োজন হয় যা তাকে খাবারের মাধ্যমে গ্রহন করতে হয়। কিন্ত কেউ যদি তার প্রয়োজনের অধিক খাবার গ্রহন করে, তবে তার গ্রহনকৃত অতিরিক্ত খাবার চর্বিতে রুপান্তরিত হয়ে দেহের চর্বি কোষে জমে মানুষকে মোটা করে দেয়। শুধু তাই নয়, রক্তনালীতে চর্বি জমে রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ নানা জটিলতার সৃষ্টি করে।
আধুনিক খাদ্যাভ্যাস ও অতিরিক্ত ওজন :
অতিরিক্ত ওজন ও স্থুলতা একটি ভয়ংকর সমস্যা যার প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। তাই বিশ্বের অসংখ্যা গবেষণাগারে চলছে স্থুলতার উপর গবেষনা। আর এ সকল গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জানা যায় যে, স্থুলতার এক অন্যতম কারণ হল ভ্রান্ত খ্যাদ্যভ্যাস এবং আমাদের ভ্রান্ত জীবন যাত্রা। গবেষকগণ বলেন সভ্যতার অগ্রযাত্রার সাথে সাথে বেড়েছে মানুষের আয়।
ফলে অধিকাংশ মানুষ হয়ে শহরমুখী। আর শহরে বাস করা মানুৃষ অতিরিক্ত চর্বি ও চিনিযুক্ত খাবার গ্রহনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু ঘর থেকে বের হয়ে শহুরে মানুষ যাতায়াত করছে যানবাহনে,ব্যস্ত জীবনে নেই শরীর চর্চার সুযোগ, ডেস্কে বসে অফিসিয়াল কাজে প্রয়োজন পরে না অধিক কায়িক পরিশ্রমের।
ফলে খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহন করা অতিরিক্ত ক্যালরি ( চর্বি, চিনি) পরিবর্তিত হয়ে চর্বি কোষে জমা হয়ে মানুষকে স্থুল বা মোটা করে দিচ্ছে আর বাড়িয়ে দিচ্ছে রোগব্যধি ও অসংখ্যা শারীরিক জটিলতা। আর তাই শহরের এই আয়েশি জীবনই আমাদের করে দিচ্ছে স্থুল আর ক্রমেই ঠেলে অকাল মৃত্যুর দিকে।
আরও পড়ুন; প্রতিদিন খালি পেটে ভেজা কিশমিশের উপকারিতা
কিভাবে বুঝবেন আপনি অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী :
প্রত্যেক মানুষের উচ্চতা ও ওজনের অনুপাতের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে। কেউ যদি সেই নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে থাকে তবে সে স্বাভাবিক ওজনের অধিকারী। বিজ্ঞানীগণ উচ্চতা ও ওজনের অনুপাতের যে সম্পর্ক নির্ধারন করেছেন সেটিকে বলা হয় বডি মাস ইনডেক্স (Body mass index) বা BMI । বডি মাস ইনডেক্স বা উচ্চতা অনুযায়ী কার ওজন কতটুকু হওয়া উচিত তা বের করার পদ্ধতি নিম্মরূপ :
বি.এম.আই (BMI) = শারীরিক ওজন (কেজি) / শারীরিক উচ্চতা (মি.)
এভাবে কারো দেহের ওজন ও শারীরিক উচ্চতার ‘অনুপাত বের করার পর যদি মান ১৮.৫-২৪.৯ এর মধ্যে থাকে তবে তাকে স্বাভাবিক ওজনের অধিকারী মনে করা হয়। আর মান ২৫.০-২৯.৯ এর মধ্যে হলে তাকে অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী এবং মান ৩০ এর অধিক হলে তাকে স্থুল ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
স্থুলতা ও অধিক ওজনের অধিকারী হওয়ার কুফল
স্থুলতা এক নীরব ঘাতক যা আমাদের দেহে নানাবিধ রোগ ও জটিলতার সৃষ্টি করে। স্থুলতার ফলে আমাদের দেহে যেসকল রোগ ও জটিলতার সৃষ্টি হয় তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম।শুধু ডায়াবেটিস নয়, স্থুলতার ফলে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুনে।
সাম্প্রতিককালের এক জরিপ হতে জানা যায় যে, ডায়াবেটিস ( ইনসুলিন অনির্ভর ডায়াবেটিস) আক্রান্তদের শতকরা ৯০ জনই অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী হয়ে থাকে। ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘ওয়াল্ড হেলথ রিপোর্ট‘ হতে জানা যায় যে, স্থুলতা প্রানঘাতী হৃদরোগ ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকিু বেড়ে যায় বহুলাংশে।
উপরোক্ত রোগগুলো ছাড়াও স্থুলতা ফ্যাটি লিভার, হারনিয়া, মূত্র নিয়ন্ত্রনে অক্ষমতা , কিডনির সমস্যা , পিত্রথলীর পাথর , সন্ধি বেদনা , আর্থ্রাইটিস পুরুষদের লিঙ্গ উথান জনিত জটিলতার সৃষ্টি করে। তাই এ সকল শারীরিক জটিলতা ও প্রানঘাতী রোগ প্রতিরোধ ওজন নিয়ন্ত্রন একান্ত জরুরী।
স্থুলতা ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া
দেহের অতিরিক্ত ওজন ও স্থুলতা শুধু উপরোক্ত রোগ ও শারীরিক জটিলতা্রই সৃষ্ট করে না বরং আমাদের মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক কালের এক গবেষনাপ্ত্র হতে জানা যায় যে, স্থুলতা মধ্যবয়স্ক মানুষের মাঝে ভুলোমনা বা ভুলে যাওয়ার প্রবণতার সৃষ্টি করে এবং কালক্রমের দেখা যায় যে, স্থুল মানুষের মস্তিষ্কের আকার স্বাভাবিক ওজনের মানুষের মস্তিষ্কের আকার অপেক্ষা ৬-৮ শতাংশ ছোট হয়ে যায়। ফলে মোটা বা স্থুলতার কোন কিছু বোঝার ক্ষমতা বয়স বাড়ার সাথে সাথে হ্রাস পায়।
অস্বাভাবিক ওজন থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েকটি কার্যকর পদ্ধতি
অস্বাভাবিক ওজন থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েকটি কার্যকর পদ্ধতি হল-নিয়মিত ব্যায়াম করা, সুষম খাদ্য গ্রহন , পর্যাপ্ত ঘুম ও পর্যাপ্ত পানি পান করা।
ব্যায়াম
নিয়মিত ব্যায়াম অতিরিক্ত ওজন কমানোর একটি কার্যকর গুরুত্বপূর্ণ উপায়। অতিরিক্ত ওজন বা ক্যালোরি খরচের মাধ্যমে ব্যায়াম আপানর শরীরে ওজনকে নিয়ন্ত্রন করে, না হলে এই “অতিরিক্ত ক্যালরি চর্বি রুপে জমা হয়। গবেষনায় দেখা যায়, ব্যায়াম অতিরিক্ত ওজন কমানোর সাথে সাথে অনেক মারাত্মক রোগের ঝুকি কমায় এবং স্বাস্থ্যরে অবস্থা আরো উন্নত করে।
তাই ওজন কমাতে যে কোন ধরনের শারীরিক কাজ যেমন; খেলাধুলা, পরিকল্পিত ব্যায়াম, ঘরের দৈনন্দিন টুকিটাকি কাজ, বাড়ি সংলগ্ন বাগানে হালকা কাজ ইত্যাদি সব কিছুই আপনার শরীরের জন্য উপকারী।
এছাড়াও অতিরিক্ত ওজন কমাতে সপ্তাহে অন্তত; ৫ দিন মাত্র ৩০ মিনিট মাঝারি ধরনের এরোবিকস ব্যায়াস ( যেমন হাটা, সাইকেল চালানো, জগিং বা হালকা দৌড়, সাতার কাটা, তালে তালে নৃত্য ইত্যাদি। সপ্তাহে ২/৩ দিন ননএরোবিকস ব্যায়াম ( যেমন-পেশীকে শক্তিশালী করার ব্যায়াম, ষ্টেচিং ব্যায়াম) করতে হবে।
সুষম খাদ্য গ্রহন
পুষ্টিকর খাবার ও উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবারগুলোকে বাদ দিয়ে কম ক্যলরিযুক্ত খাবার দিয়ে একটি সুষম খাদ্য তালিকা তৈরী করুন এবং তা প্রতিদিন মেনে চলুন। তাজা ফল ও খাদ্য শস্য , কম চর্বিযুক্ত মাংস, তাজা-শাকসবজি, টক দই ইত্যাদি খাবন। ফাস্টফুড, মিষ্টি , সফট , ড্রিংস, চা, কফি,চকলেট, আইসক্রিম,ভাজা ও তৈলাক্ত খাবার , চর্বিযুক্ত মাংস , মাখন, মার্জারিন যথা সম্ভব বর্জন করুন।
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন। কারন ওজন কমানোর জন্য প্রতিদিন ২/৩ লিটার পানি পান করা উচিত। সম্ভব হলে মাঝে মাঝে কুসুম গরম পানিতে লেবু মিশিয়ে খাবেন, ইহা আপনার শরীরের ক্ষতিকর চর্বিসমূহকে ধৌত করে অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সহায়তা করে। খাওয়ার আগে ১/২ গ্লাস পানি পান করুন, এত দ্রুত ও দীর্ঘস্থায়ীভাবে আপনার পেট ভরার অনুভুতি আসবে।
পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম
পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমান। ঘুমানো অবস্থায় আমাদের কোষগুলো পুনরায় উজ্জীবিত হতে থাকে। তাই দৈনিক কমপক্ষে ৬-৭ ঘন্টা ঘুমান। না হলে কখনোই অতিরিক্ত ওজন কমানো সম্ভব না।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url