মায়ের বুকের দুধের গুরুত্ব-মায়ের বুকের দুধের উপকারিতা

মায়ের বুকের দুধ

মায়ের বুকের দুধের গুরুত্ব ও উপকারিতা অনেক। মায়ের বুকের দুধে মানব শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান যথাযথ মাত্রায় থাকে। ফলে শিশু তার প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত ও পরিমিত পুষ্টি পেয়ে থাকে। একটা শিশু জন্মের পর তার সামগ্রিক জীবনে মায়ের বুকের দুধের উপকারিতার কার্যকারিতা ব্যাপক।
মায়ের বুকের দুধের গুরুত্ব-মায়ের বুকের দুধের উপকারিতা

জন্মের পর থেকে মায়ের দুধের বিকল্প বা সমতুল্য খাবার তৈরি হয় নি। যদিও বিশেষ কিছু কারনে একটা শিশু জন্মের পর মায়ের দুধ হতে বঞ্চিত হয়। ফলে শিশু কে বিকল্প খাবার হিসেবে গরুর দুধ বা বাজার থেকে প্রাপ্ত দুধ খেতে হয় । যা, একটা শিশুর বাড়ন্ত জীবনে সঠিক কার্যকারিতা দিতে পারে না। 

পোস্ট সূচিপত্র

 রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি :

মায়ের দুধে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ উপাদান যেমন আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি  এসিড, লেনোলেইক এসিড ও ভিটামিন ই থাকে যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে এবং শিশু ও মা উভয়কে ঐসব রোগ থেকে রক্ষা করে। 

এজন্য মায়ের দুধ কে শিশুর প্রাথমিক টিকা বলা হয়। সত্তরের দশকের শুরুতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বুকের দুধ খাওয়া শিশুর তুলনায় কৌটার দুধ খাওয়া  শিশুদের অপুষ্টি  এবং সংক্রামক রোগের কারনে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। 

মস্তিষ্কের গঠন :

মানুষের মস্তিষ্কে ৬০ % চর্বি থাকে। এদের মধ্যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি েএসিড এবং ডেকোসাহেক্সানোয়িক এসিড প্রধান। নিউরনের কোষ প্রাচীরে প্রচুর পরিমাণে চর্বি থাকে। কোষ প্রাচীরে বিভিন্ন ধরনের চর্বির অনুপাতের  উপর মস্তিষ্কের সঠিকভাবে কাজ করার ক্ষমতা নির্ভর করে। আমাদের শরীরের জন্য কিছু বিশেষ চর্বির প্রয়োজন। 

যেমন -  ডেকোসাহেক্সানোয়িক এসিড (DHA) , ওমেগা-৩ পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড (PUFA), এগুলো আমাদের চোখ এবং ব্রেইনের জন্য খুবই উপকারী। কারন DHA ও PUFA আমাদের চোখের এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা সঠিক রাখতে সাহায্য করে। 

খাদ্যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড , ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড এবং ডেকোসাহেক্সানোয়িক এসিডের অভাব হলে পারকিনসন্স ডিজিজ, হতাশা, অ্যালঝেইমার্স ডিজিজ, সিজোফ্রেনিয়ার মত মারাত্মক রোগ হয়। শিশুদের ব্রেইন স্বাভাবিক ভাবে গড়ে ওঠার জন্য DHA  অত্যন্ত জরুরী। কারন তাদের  অনেক কিছু জানতে এবং শিখতে হয়। 

তাদের বুদ্ধি দিন দিন পরিণত হয়। শিশু গর্ভে থাকাকালীন গর্ভফূল হতে এবং জন্মের পর মায়ের দুধ হতে DHA  পেতে থাকে। মায়ের বুকের দুধে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় DHA  থাকে এবং মায়ের দুধ খাওয়া শিশুরা এইসব মারাত্মক রোগের ঝুকিমুক্ত থাকে। 

এলার্জি ও হাপানি প্রতিরোধ :

গবেষণায় দেখা গেছে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমানে বুকের দুধ খেলে শিশুর এলার্জির প্রবণতা কম থাকে। ৪ মাস বয়স পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমানে বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের হাপানির ঝুকি কম থাকে।

স্থুলতা হতে মুক্ত :

মায়ের দুধ খাওয়া শিশুরা জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে স্থুলতার ঝুকি হতে মুক্ত থাকে।

ডায়বেটিসের ঝুকিমুক্ত :

যেসব শিশু জীবনের প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ খায় তাদের ডায়াবেটিসের ঝুকি কম থাকে।

দাত ও দাতের মাড়ির সুস্থতা :

যেসব শিশু পর্যাপ্ত পরিমানে বুকের দুধ খায় তাদের দাত সুস্থ ও সুগঠিত থাকে এবং দাতের মাড়ি সবল থাকে।

সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ :

বুকের দুধ পানকারী শিশুরা বিভিন্ন  ধরনের সংক্রামক রোগ হতে মুক্ত থাকে। যেমন- ডায়রিয়া, কানের রোগ, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ , মেনিনজাইটিস, একজিমা, আই বি এস ( আলসারেটিভ কোলাইটিস, ক্রোনস ডিজিজ) রোগ হতে মুক্ত থাকে।

ক্যান্সারের ঝুকি হ্রাস :

৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ  এবং দুই বছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার খেলে শিশু ক্যান্সারের ঝুকিমুক্ত থাকে। যেমন হজকিনস ডিজিজ, লিউকেমিয়া ইত্যাদি।

কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি :

গরুর দুধ বা কৌটাজাত দুধ খাওয়া শিশুদের তুলনায় মায়ের বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের তুলনায় মায়ের বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের পায়খানা কম গন্ধযুক্ত এবং নরম হয়। শিশুদের গ্যাস্ট্রোইন্টেসটাইনাল ট্রাক্টে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার কারনে এরকম হয়ে থাকে। নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য হয় না।

হৃদ্যতা এবং মানসিক প্রভাব :

বাবা মায়ের সাথে সন্তানের হৃদ্যতা গর্ভাবস্থায় শুরু হয় এবং জন্মের পর তা বাড়তে থাকে। এই  হৃদ্যতার জন্য বাবা মা সন্তানের জন্য যেকোন ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। অনেক মহিলার মতে বুকের দুধ খাওয়ানো তাদের জীবনের একটি স্বরণীয় ঘটনা।

বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি :

গবেষনায় দেখা গেছে, বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের অন্যান্য শিশুদের তুলনায় বুদ্ধিবৃত্তি বেশি হয়ে থাকে। তারা যেকোন বিষয় দ্রুত বুঝতে সক্ষম হয়।

বিভিন্ন ধরনের স্বাদে অভ্যস্ততা :

দিনের বিভিন্ন সময় এবং দুধ খাওয়ানোর সময় মায়ের বুকের দুধের উপদানের সংযুক্তি পরিবর্তিত হয়। বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রথম পর্যায়ের তুলনায় শেষের পর্যায়ের দুধে চর্বি বেশি থাকে। মায়ের খাবারের উপর ভিত্তি করে বুকের দুধের স্বাদ পরিবর্তিত হয়। এর ফলে শিশু বিভিন্ন ধরনের স্বাদে অভ্যস্ত হয়।

অন্যান্য :

মায়ের দুধের প্রোটিনে কেসিন কম থাকে, এর ফলে শিশুর হজম ভাল হয়। মায়েল দুধ ল্যাকপেজ কম থাকায় শরীরে সল্ট বা লবনও কম জমে। মায়ের দুধে ক্যালসিয়াম, আয়রণ ঘটিত লবন শিশুর শরীরে ভালভাবে শোষিত হয়। মায়ের দুধে সোডিয়াম পরিমাণ নিরাপদভাবে কম থাকে বলে নবজাতক শিশুর কিডনিতে কোন ধরনের সমস্যা হয় না এবং শিশু পানি স্বল্পতা হতে মুক্ত থাকে। 

মায়ের জন্য :

মায়ের বুকের দুধ সন্তান খাওয়ালে সন্তানের যেমন উপকারিতা হয় ঠিক তেমনি মায়ের নিজেরও অনেক উপকার সাধিত হয়। নিচে মায়ের উপকারিতা গুলো তুলে ধরা হলো।

গর্ভাশয়ের পুর্ব আকৃতি প্রাপ্তি :

বুকের দুধ পান করালে প্রোল্যাক্টিন ও অ্যাক্সিটোসিন নামক হরমোন নি;সৃত হয়। গর্ভকালীন সময়ে বড় হয়ে যাওয়া গর্ভাশয়ের পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে অক্সিটেসিন হরমোন সহায়তা করে। বুকের দুধ পান করাকালীন সময়ে নি:সৃত অক্সিটোসিন গর্ভাশয়ের দ্রুত পুর্বে অবস্থানে ফিরে যেতে সহায়তা করে।

জন্মনিয়ন্ত্রক :

শিশুকে জন্মের প্রথম ছয়মাস যথাযথভাবে বুকের দুধ পান করালে এবং বুকের দুধ ছাড়া অন্য কোন খাবার না দিলে মাসিক ঋতুস্রাব দেরিতে শুরু হয়। ফলে মায়ের আবার গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে এই পদ্ধতি খুব একটা নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি নয়। এই সময়ে জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি খেলে বুকের দুধ কম যেতে পারে। এজন্য অন্য কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত।
 

স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ :

গবেষনায় দেখা গেছে  যে, যারা বুকের দুধ পান করিয়েছেন তার পরবর্তীতে স্তন ক্যান্সারের ঝুকিমুক্ত থাকেন। কারন বুকের দুধ পান করালে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কম থাকে। কম মাত্রার ইস্ট্রোজেন স্তন ক্যান্সারের ঝুকি কমায় এবং স্তনের এডিপোস টিস্যুতে জমা হওয়া ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে দুরীভুত হয়ে যায়।

মায়ের দুধ খাওয়ানো ঝামেলাহীন :

  • মায়ের দুধে কোন রোগ জীবাণু বা ময়লা থাকে না।
  • মায়ের দুধ বিশুদ্ধ ও খাটি।
  • মায়ের দুধ জ্বাল দিতে হয় না বা গরম করতে হয় না।
  • মায়ের দুধ খাওয়াতে কোনো আনুষঙ্গিক ঝামেলা নেই, যেমন- হাড়ি, বোতল, জ্বালানী ইত্যাদি।
  • মায়ের দুধ যখন খুশি খাওয়ানো যায়।
  • মায়ের দুধ খেলে শিশু পরিপূর্ণ নাগরিক হিসেবে গড়ে ‍উঠে।
  • শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ালে দেশের  বৈদেশিক মুদ্রা বাচে।

মায়ের দুধ না খাওয়ার অসুবিধা :

শিশুকে মায়ের দুধ না খাওয়ালে বা পর্যাপ্তভাবে না খাওয়ালে হলে শিশু ,মা,সমাজ,পরিবেশের উপর এর বিরুপ প্রভাব পড়ে।

শিশুর জন্য :

  • শিশুকে কৃত্রিম খাদ্য বা গরুর দুধ খাওয়ালে তার ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, কানপাকা, এলার্জিসহ বিভিন্ন অসুখ হতে পারে।
  • অসুস্থতার কারনে শিশু খিটখিটে মেজাজের হয়, মাকে বিরক্ত করে, কাজে বাধা সৃষ্টি করে।
  • অসুস্থতার কারনে তার বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে তার অপুষ্টি হয়।
  • DHA নামক উপাদানের অভাবে বৃদ্ধি কম হয়।
  • নবজাতকের জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়।
  • পরবর্তীতে জীবনে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
  • হজম যন্ত্রের পরিপক্কতা দেরীতে হয় এবং ঘন ঘন ডায়রিয়া হয়। 
  • শিশু খাদ্যের চড়া মুল্যের কারনে অনেকেই প্রয়োজনের তুলনায় পাতলা দুধ দিয়ে থাকেন ফলে শিশু অপুষ্টির শিকার হয়।
  • শুয়ে শুয়ে বোতলে দুধ খাওয়ার ফলে অনেক সময় কানে দুধ ঢুকে যায় এবং কান পাকা রোগ হয়।
  • গরুর দুধে অতিরিক্ত লবণ থাকে যা অপরিপক্ক কিডনির জন্য ক্ষতিকর।

মায়ের জন্য

  • মায়ের শ্রীঘ্রই পুনরায় গর্ভবতী হওয়ার সম্বাবনা বেড়ে যায়।
  • তোলা খাবার ক্রয় করে খাওয়ানোর জন্য খাবার তৈরি করা বা গরম করা , বিশুদ্ধ পানি জোগাড় করা ইত্যাদি নানা ঝামেলা মাকে পোড়াতে হয়।
  • শিশুর খিদে ফেলে রাতে উঠে দুধ তৈরী করে খাওয়ানো ঝামেলার কাজ। এতে মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত হয় এবং স্বাস্থ্য খারাপ হয়।
  • শিশুকে দুধ না খাওয়ালে পরবর্তীতে স্তন, জরায়ু বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
  • মায়ের সাথে সন্তানের দুরত্ব বেড়ে যায়।

পরিবারের জন্য

  • বুকের দুধ না খাওয়ানোর ফলে শিশু প্রায়ই অসুস্থ থাকে। ফলে চিকিৎসার খরচ বেড়ে যায়।
  • শিশু খাদ্য উচ্চ ক্রয়মুল্যের ফলে পরিবারে অভাব দেখা দেয়।

মায়ের দুধ বৃ্দ্ধিতে কার্যকর ভেষজ :

শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমানে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য শিশুর মাকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুন সম্পন্ন খাবারের পাশাপাশি নিম্মলিখিত ভেষজ উদ্ভিদ খেতে হবে। ফলে মায়ের স্তনে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

 

শিমুল মূল , ‍মুথা ‍মূল, শতমূলী, শ্বেত লতা পলাশ, জিনসেং, গোক্ষুর কাটা

১-৩ গ্রাম পরমাণমত দুধসহ সেব্য

মিষ্টি আলু, গোল আলু, চুপড়ি আলু, চালকুমড়া, ভুইকুমড়া,আলকুশী,লাউ,কলা

রান্না করে খাবেন

কালোজিরা

ভর্ত করে খাবেন

লাউশাক, কলমি শাক, হেলেঞ্চা শাক, নুনিয়া শাক

ঝোল করে খাবেন

আঙ্গুর, খেজুর

ঝোল করে খাবেন


পরিশেষে, আমি আমার আজকের এই আর্টিকেলে চেষ্টা করেছি আপনাদের কে মায়ের বুকের দুধের গুরুত্ব ও উপকারিতার বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরতে এবং আশা করছি আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী পুরো বিষয়টি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছি। আপনার পরিবার ও পরিজনের সামগ্রিক উন্নতি কামনা করে আজকের আর্টিকেলটি এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url